Latest Post

 

 নবম-দশম শ্রেণীর সাধারণ গণিত সমাধান

July 13, 2020
গরু❌= গোরু✅
ভিডিও❎=ভিডিয়ো✅

রাণী❌=রানি✅
ঠেলা❎=ঠ্যালা✅

পটল❌=পটোল✅
ঘুষ❎=ঘুস✅

সাথী❌=সাথি✅
ফর্সা❎=ফরসা✅

পীর❌=পির✅
কৈ❎=কই✅

ব্যাঙ❌=ব্যাং✅
অংক❎=অঙ্ক✅

বিদায়ী❌=বিদায়ি✅
পাদ্রী❎=পাদরি✅

ঠেলাগাড়ি❌=ঠ্যালাগাড়ি✅
বৌভাত❎=বউভাত✅

ঈগল❌=ইগল✅
ঈদ❎=ইদ✅

বৈ কি❌=বইকি✅
উছিলা❎=ওসিলা✅

পেত্নী❌=পেতনি✅
তরী❎=তরি✅

আপোস❌=আপস✅
রজনী❎=রজনি✅

পরিষ্কার❌=পরিস্কার✅
ফার্সি❌=ফারসি✅

সমসাময়িক❎=সামসময়িক✅
ক্ষুধামন্দা❎=ক্ষুধামান্দ্য✅

অংশীদারিত্ব❌=অংশিদারত্ব✅
অনুষ্ঠিতব্য❎=অনুষ্ঠাতব্য✅

ফর্মুলা❌=ফরমুলা✅
মহামারী❎=মহামারি✅

বিবাদমান❌=বিবদমান✅
প্রবাহমান❎=প্রবহমান✅

বিচারিক❌=বৈচারিক✅
অহর্নিশি❎=অহর্নিশ✅

ভূমিকা : চরিত্র এমন একটি শক্তি, ব্যক্তিত্বের এমন একটি দিক যা ন্যায় নীতি ও নৈতিক জীবনাচরণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত। একজন মানুষের স্বভাবে ভালো-মন্দ দুটো দিকই থাকতে পারে। মন্দের পাল্লা ভারি হলে সে দুশ্চরিত্র বলেই পরিচিত হয়। অন্যদিকে সৎ চরিত্রের অধিকারী বলতে আমরা বুঝি তিনি ন্যায়বান ও সুবিবেচক। অন্তর শক্তির দৃঢ়তা, অধ্যাবসায় ইত্যাদিও সুচরিত্রের অঙ্গ। চরিত্র অনুযায়ী গঠিত হয় ব্যক্তিজীবন যার প্রভাব গড়ে পরিবেশ ও সমাজ জীবনের ওপর।

চরিত্র কী : চরিত্র শব্দটি ইংরেজি ‘Character’ শব্দের প্রতিশব্দ হলেও মূলত তা এসেছে গ্রিক থেকে। আদিতে এর অর্থ ‘চিহ্ন’ হলেও প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে থেকে শব্দটি ব্যক্তির আচরণ ও আদর্শের উৎকর্ষবাচক গুণ বোঝাতেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
চরিত্র গঠনের দুটো দিক রয়েছে। সচ্চরিত্র ও দুশ্চরিত্র। উৎকর্ষবাচক নানা গুণের সমন্বয়ে গঠিত চরিত্র সচ্চরিত্র। আর মানুষের মধ্যে লুকানো অপকর্ষ বা পশুত্ব যদি হয় চরিত্রের মূল বৈশিষ্ট্য তবে সেই চরিত্রই দুশ্চরিত্র। চরিত্র মানবজীবনের এক মহামুল্যবান অবিনাশী সম্পদ। যিনি সৎ চরিত্রের অধিকারী তিনি সমাজের শ্রেষ্ঠ অলঙ্কার ও প্রজ্বলিত দীপশিখা। এ কারণেই চরিত্রকে জীবনের মুকুট বলা হয়। মুকুট যেমন সম্রাটের শোভা বর্ধন করে, তেমনি চরিত্র মানবজীবনের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। সততা, সহৃদয়তা, সংবেদনশীলতা, ন্যায়পরায়ণতা, ক্ষমা, ঔদার্য, কর্তব্যপরায়ণতা, গুরুজনে ভক্তি, মনবিকতা ও আত্মসংযম ইত্যাদি সচ্চরিত্রের লক্ষণ। যিনি চরিত্রবান তিনি কখনও সত্য পথ থেকে বিচ্যুত হন না, অন্যায়কে প্রশ্রয় দেন না। তিনি সযত্নে ক্রোধ, অহঙ্কার, রূঢ়তা ইত্যাদিকে পরিহার করেন। তিনি হন সত্যবাদী, সংযমী ও ন্যায়পরায়ণ। যাবতীয় মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটে বলে চরিত্রবান মানুষ জাতির সম্পদ।

চরিত্র ঘঠনের গুরুত্ব : মানুষের জীবনে চরিত্রে মূল্য ও গুরুত্ব কতখানি তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। কেবল চরিত্রের শক্তিতে ও প্রভাবে মানুষ হতে পারে বিশ্ববরেণ্য ও চিরস্মরণীয়। বিদ্যার মূল্য মানবজীবনে অপরিসীম। কিন্তু বিদ্যার চেয়ে চরিত্রকেই অনেক সময়ে দেওয়া হয় অধিকতর গুরুত্ব। প্রবাদ আছে-
‘দুর্জন বিদ্যান হলেও পরিত্যাজ্য।’

কারণ, বিদ্যান লোক দুর্জন হলে তা সমাজের কল্যাণ না হয়ে অকল্যাণই হয় বেশি। এ প্রসঙ্গে একটি সুভাষিত স্মরণীয় উক্তি :
‘অমরত্বের সুধা পান না করেও মানুষ অমর হতে পারে কেবল চরিত্রের গুণে।”

তাই চরিত্রের বিকাশ সাধনই মানুষের লক্ষ্য হওয়া উচিত। পৃথিবীতে নিজেকে খাঁটি ও উন্নত করে গড়ে তোলাই মানুষের কাম্য। চরিত্রের মাধ্যমে মানুষের জীবন পদ্ধতিই কেবল নির্ধারিত হয় না, চরিত্রই এক অর্থে মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করে।

চরিত্র গঠন-মূলক শিক্ষার লক্ষ্য : চরিত্র গঠনমূলক শিক্ষার লক্ষ্য হচ্ছে, যুক্তির শক্তিতে সমাজস্বীকৃত আচরণ অনুসরণে ব্যক্তির ইচ্ছা ও সামর্থ্যকে বিকশিত করা। ব্যক্তির চারিত্রিক গুণাবলি বিকাশের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত দিকগুলো শিক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্ব পাওয়া প্রয়োজন।

১. মানবিক গুণাবলির সমাহার হিসেবে ধৈর্য, সাহস, আনুগত্য, সততা, সৌজন্য, নির্ভরযোগ্যতা, কৃতজ্ঞবোধ, সহজ অমায়িকতা, পরহিতব্রত ইত্যাদি গুণাবলি;
২. শৃঙ্খলা, সময়ানুবর্তিতা, পরমত সহিষ্ণুতা, শিষ্টাচার ইত্যাদি সামগ্রিক আচার-আচরণ-অভ্যাস;
৩. দেশপ্রেম, অসাম্প্রদায়িকতা, জাতীয়তাবোধ, আন্তর্জাতিক সৌভ্রাতৃত্ব, মানবপ্রেম ইত্যাদি সংগঠিত ভাবাবেগ;
৪. হিংসা, বিদ্বেষ, কুটিলতা ইত্যাদি মানসিতা পরিহার এবং বদ অভ্যাস বা প্রবৃত্তি দমন;
৫. ন্যায়বিচার, মানবকল্যাণ, পরহিতব্রত ইত্যাদি মানবিক গুণাবলিকে জীবনের চালিকা শক্তি হিসেবে গ্রহণ।
শিক্ষার মাধ্যমে চরিত্র গঠনের পদ্ধতি : দেশ ভেদে কাল ভেদে চরিত্র গঠনমূলক শিক্ষায় ধারণা, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে পার্থক্য দেখা যায়। তা সত্ত্বেও বলা যায়, সুপ্রাচীন কাল থেকেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় চরিত্র গঠনের উপর বিশেষ গরুত্ব আরোপ করা হয়ে আসছে। এক্ষেত্রে দুটি পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়ে থাকে; প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ। প্রত্যক্ষ পদ্ধতিতে গুরুত্ব পায় : ন্যায়নীতি শিক্ষা, নৈতিক মান গঠন; কাজ, সততা, সৌন্দর্য, সৌজন্য, কৃতজ্ঞাবোধ ইত্যাদি গুণাবলির প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি; পশুপাখির প্রতি মমত্ব ও পরিবেশ রক্ষায় সচেতনতা সৃষ্টি। সামগ্রিকভাবে প্রত্যক্ষ পদ্ধতির লক্ষ্য হচ্ছে ব্যক্তির চারিত্রিক গুণাবলি ও সুঅভ্যাস গড়ে তোলায় সহায়তা দান।
চরিত্র গঠনমূলক শিক্ষার পরোক্ষ পদ্ধতি হচ্ছে ইতিহাস, জীবন ও সাহিত্য থেকে পাঠের মাধ্যমে দৈনন্দিন আচরণ ও মূল্যবোধ সৃষ্টি। এভাবে মহৎ চরিত্র সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের মনে আদর্শ ধারণা সৃষ্টি করা হয়।
চরিত্র গঠনে বাবা-মা, পাড়া-প্রতিবেশীর ভূমিকা ছাড়াও বয় স্কাউট, গার্ল গাইড, রেডক্রস ইত্যাদি সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা গুরুত্বপূর্ণ। স্বেচ্ছা সংগঠনের মাধ্যমে মানুষ যৌথ কাজের গুরুত্ব ও আনন্দ অনুভব করতে পারে।

শিশু বয়সে চরিত্র গঠন : শিশুর চরিত্র যেন নির্মল ও স্বচ্ছ হয় সেজন্যে উপযুক্ত শিক্ষাদানে অভিভাবকদের পাশাপাশি তৈরি করতে হয় অনুকূল পরিবেশ। শিশুকে সৃষ্টিশীল কাজে উৎসাহিত করা হলে তাতে সৃজনী প্রতিভা বিকশিত হয়। শিশুর জীবনে মহৎ গুণের সমাবেশ ঘটাতে হলে চাই সৎ সঙ্গ। পিতামাতা, সঙ্গীসাথী, আত্মীয়-পরিজন সৎ চরিত্রের অধিকারী না হলে এদের সাহচর্যে শিশুর মধ্যে সচ্চরিত্রের গুণগুলো সুদৃঢ় ভিত্তি পেতে পারে না।
পারিবারিক পরিবেশ ছাড়াও শিশুর নৈতিক বিকাশে বিদ্যালয় জীবন ও শিক্ষক-শিক্ষিকার প্রভাব গরুত্বপূর্ণ। শিক্ষকের কাজ শিশুকে সুশিক্ষা দেওয়া। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে মহৎ গুণের সমাবেশ ঘটানোর গুরুদায়িত্ব তাঁদেরই। আজকাল শিশুর ভালো-মন্দ চরিত্র গঠনে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখছে টেলিভিশন ও স্যাটেলাইট চ্যানেলের মতো গণমাধ্যম। স্যাটেলাইটের বিভিন্ন চ্যানেলে যেসব অনুষ্ঠান প্রচার করা হয় তার মধ্যে এমন অনুষ্ঠানও থাকে যা শিশুর জন্যে অনুপযোগী। শিশুস্বভাবতই টেলিভিশনের অনুষ্ঠানের প্রতি আকৃষ্ট হয়। তাই অভিভাবককে অবশ্যই দৃষ্টি দিতে হবে যাতে তাদের শিশুদের চরিত্রের ওপর অপকৃষ্ট অনুষ্ঠানের কুপ্রভাব না পড়ে। এ কারণে খুন-জখম, মারামরি ও স্থুল বিকৃত রুচির বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান শিশুর চরিত্র গঠনের ক্ষেত্রের ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। তাই এ ধরণের অনুষ্ঠান দেখা থেকে শিশুকে বিরত রাখতে হবে।
তবে সর্বোপরি যে জিনিসটির ওপর অভিভাবককে বিশেষ সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে তা হলো সৎ সঙ্গ। কুসঙ্গের পাল্লায় পড়ে অনেক সম্ভাবনাময় প্রতিভা অকালে ঝরে পড়ে, হারিয়ে যায় অন্ধকারে। এ সম্পর্কে প্রবাদ আছে- ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।’ তাই শিশুর সঙ্গী ও বন্ধু নির্বাচনে অভিভাবকের সতর্ক বিবেচনা দরকার।

চরিত্র গঠনের সাধনা : চরিত্র গঠনের জন্যে ব্যক্তির নিজস্ব সাধনাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। লোভ লালসা ও অসৎ প্রবৃত্তির নানা কুপ্রলোভন মানুষকে পাপের পথে টানে। এসব পাপ পথ সতর্ক ও দৃঢ়চিত্তে পরিহার করে লোভকে জয় করার শক্তি অর্জন করে চরিত্রবানের আদর্শকে মশাল হিসেবে জ্বালিয়ে উন্নত জীবনের সাধনায় নিযুক্ত হলেই সুচরিত্র গঠনে এগিয়ে যাওয়া যায়। কেবল তাই নয়, চরিত্র রক্ষার জন্যেও মানুষকে আমৃত্যু নিরন্তর সাধনা করে যেতে হবে। ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে-
When money is lost nothing is lost
When health is lost something is lost
When character is lost everything is lost.

অর্থাৎ টাকা হারালে টাকা অর্জন করা যায়, স্বাস্থ্য হারালে তাও পুনরুদ্ধার করা যায়, কিন্তু চরিত্র হারালে তা আর ফিরে পাওয়া যায় না। তাই মনুষ্যত্বের অধিকারী হবার জন্যে গড়ে তুলতে হবে সুন্দর, নির্মল ও পরিচ্ছন্ন চরিত্র।

মহৎ চরিত্রের দৃষ্টান্ত : পৃথিবীতে যারা চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন তাঁরা ছিলেন চরিত্র শক্তিতে বলীয়ান। কোনো প্রলোভনই তাদেরকে ন্যায় ও সত্যের পথে বিচ্যুত করতে পারে নি। এমনই চরিত্রের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.)। তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন অন্যায়, অসত্য ও পাপের বিরুদ্ধে। যুগে যুগে সকলেই ছিলেন মানবব্রতী, ছিলেন উত্তম চরিত্রের অধিকারী। বিদ্যাসাগর, রামমোহন, রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা গান্ধী, শেরে বাংলা ফজলুল হক, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, মওলানা ভাসানীর মতো মানবব্রতী, সমাজব্রতী, দেশব্রতী মহাপ্রাণ সকলেই ছলেন উন্নত ও মহৎ চরিত্রের অধিকারী। এমনি আরো অনেক মহৎ চরিত্রের মৃত্যুতে বিশ্বের মানুষ অশ্রুজল ফেলেছে। তাঁদের জীবনের মহিমা স্মরন করেই কবি লিখেছেন-
’এমন জীবন হবে করিতে গঠন
মরণে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন।’

চরিত্রবান ব্যক্তি ধনসম্পদে, জ্ঞান-বিজ্ঞানে ও বংশ মর্যাদায় কাঙাল হলেও গৌরবে মহান। এ জন্যেই সুভাষিত উক্তিতে বলা হয়েছে:
‘রাজার প্রতাপ অর্থ-সম্পদে কিন্তু চরিত্রবানের প্রতাপ হৃদয়ে।’

উপসংহার : পরিভোগপ্রবণ বিশ্বে আজ চারপাশে বাড়ছে মূল্যবোধের অবক্ষয়। চরিত্রের শক্তি হারিয়ে ফেলতে বসেছে মানুষ। ক্রমেই ডুবে যাচ্ছে অনৈতিক জীবনের অন্ধকারের অতলে। এ অবস্থায় জাতীয় জীবনে চাই চরিত্রশক্তির নবজাগরণ। যে প্রজন্ম চরিত্র হারিয়েছে তার কাছে কিছু আশা করার নেই। কিন্তু নতুন প্রজন্মকে বেড়ে উঠতে হবে চরিত্রের মহান শক্তি অর্জন করে। তা হলেই আমাদের ভবিষ্যৎ হবে সুন্দর।

↬ কর্ম  ও জীমনমূখী শিক্ষা 
↬ আত্মকর্মসংস্থানমূখী শিক্ষা 
↬ উৎপাদনমুখী শিক্ষা 
↬ জনসংখ্যার অভিশাপকে আশির্বাদে রূপান্তর
↬ কারিগরি শিক্ষা

ভূমিকা : শিক্ষা মানুষের সুপ্ত সম্ভাবনার বিকাশ ঘটায়। জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রে তাকে সামর্থ্য ও দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করে। বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কার ও সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক অগ্রগতির ফলে মানব জীবনের নিত্যনতুন কর্মদিগন্ত খুলে গেছে। ফলে বংশানুক্রমিক পেশাগত বৃত্তি অবলম্বন করে নিশ্চিত জীবনযাপনের দিন ফুরিয়ে গেছে। বরং নিত্যনতুন যে কর্মদিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে তার সঙ্গে বিশেষায়িত শিক্ষার যোগ হয়ে পড়েছে অপরিহার্য। এই কারণে আধুনিক বিশ্বে সাধারণ শিক্ষার চেয়ে কর্মমুখী শিক্ষা ক্রমের অধিকতর গুরুত্ব লাভ করছে।

সংজ্ঞা ও গুরুত্ব : কর্মমুখী শিক্ষা হচ্ছে জীবিকা অর্জনের জন্যে সম্ভাব্য পেশাগত কর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত শিক্ষা। মানুষের জীবনযাত্রার ধরন ও বৈশিষ্ট্যের ব্যাপক পরিবর্তন এবং জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতার ফলে কর্মমূখী শিক্ষার গুরুত্ব ও চাহিদা বাড়ছে। এককালে অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে বাস করে বাংলাদেশের মানুষ সুখে জীবন কাটিয়েছে। বৃত্তি বা পেশাগত শিক্ষা নিয়ে তাকে ভাবতে হয় নি। বংশানুক্রমিক পেশা অবলম্বন করেই জীবিকা নির্বাহ করেছে। কিন্তু এখন সে দিন আর নেই। জনসংখ্যা এখন বেড়েছে বিপুলভাবে। তার প্রচন্ড চাপ পড়েছে সীমিত সম্পদের ওপর। ফলে বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি অগ্রগতিকে কাজে লাগিয়ে আমাদের দেশে নব নব কর্মসংস্থান ও অগ্রগতির পথে অগ্রসর না হলে জাতীয় জীবনে নেমে আসবে অনিবার্য সংকট।
আর তার জন্যে দরকার নিত্যনতুন কর্ম, বৃত্তি ও পেশার সঙ্গে জড়িত কর্মমুখী শিক্ষা। কিন্তু দুঃখের বিষয় দেশে এখনও সেই ইংরেজ আমলে প্রবর্তিত প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতিতে কেরানি তৈরির উপযোগী সাধারণ শিক্ষার প্রাধান্যই রয়ে গেছে। ফলে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ডিঙিয়ে যারা বের হচ্ছে কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত না হওয়ায় তাদের ব্যাপক অংশেই বেকারত্বের অভিশাপ বয়ে বেড়াচ্ছে এবং প্রচন্ড হতাশায় জীবনের ওপর আস্থা হারাচ্ছে। এই কারণে যতই দিন যাচ্ছে কর্মমুখী বা বৃত্তিমূলক শিক্ষার গুরুত্ব সবাই উপলব্ধি করছে। বিশ শতকের শেষ দশকে আমাদের দেশে কর্মমুখী শিক্ষার গুরুত্ব বিশেষভাবে উপলব্ধি করা গেছে। এটা এখন স্পষ্ট যে, বর্তমান বাস্তবতায় কর্মমুখী বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। তা দেশের অগ্রগতি সাধনে যেমন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে তেমনি দেশে এবং দেশের বাইরে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে বেকারত্ব মোচনেও ফলপ্রসূ অবদান রাখতে সক্ষম। এতে বহু পরিবার অশান্তির হাত থেকে বাঁচতে পারে। এই শিক্ষার প্রসার ঘটলে সাধারণ ও উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে অনভিপ্রেত ভিড় হ্রাস পাবে। তাছাড়া কর্মমুখী শিক্ষা স্বকর্ম সংস্থানের নানা সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে এবং তা ফলত দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় ও দারিদ্র্য দূরীকরণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। কর্মমুখী শিক্ষা কেবল নতুন নতুন কর্মস্থানের সুযোগ তৈরি করে না, কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের নানা ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রেখে দেশের উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পারে। সেদিক থেকে কর্মমুখী শিক্ষা জাতির অর্থনৈতিক বুনিয়াদ রচনায়ও ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করতে পারে। কর্মমুখী শিক্ষা স্বাধীন পেশা গ্রহণে ব্যক্তির আস্থা গড়ে তোলে, তাকে স্বাবলম্বী করে তোলে এবং এভাবে বিপুল সংখ্যক বেকারত্বের হাত থেকে জাতিকে বাঁচায় এবং পরমুখাপেক্ষী অবস্থায় অভিশাপ থেকে রক্ষা করে। বিজ্ঞানের বিস্ময়কর উন্নতির যুগে কর্মমুখী শিক্ষা তাই আমাদের দেশের মতো উন্নয়নশীল দেশেও অনিবার্যভাবে প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে।

কর্মমুখী শিক্ষার স্বরূপ : কর্মমুখী শিক্ষা যান্ত্রিক শিক্ষা নয়। জীবনমুখী শিক্ষার পরিমন্ডলেই তার অবস্থান। পরিপূর্ণ ও সামগ্রিক জীবনবোধের আলোয় বিচার করা হয় কর্মমুখী শিক্ষার ভূমিকাকে। কর্মমুখী শিক্ষা নিঃসন্দেহে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক জনশক্তি সৃষ্টি করতে চায় কিন্তু তার মানবিক গুণাবলির বিকাশের দিকটিও উপেক্ষিত থাকতে পারে না। এদিক থেকে কর্মমুখী শিক্ষার লক্ষ ত্রিমুখী:

ক. জ্ঞান জিজ্ঞাসা সৃষ্টিতে : জ্ঞান-বিজ্ঞানের অর্জনের সঙ্গে শিক্ষার্থীর পরিচয় ঘটানো, অজানাকে জানার আগ্রহ সৃষ্টি এবং সুপ্ত গুণাবলির বিকাশ ঘটানো।

খ. মূল্যবোধ সৃষ্টি : শিক্ষার্থীকে নৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় এবং মানবিক-সাংস্কৃতিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত করা এবং গণতন্ত্রমনা, যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক নাগরিক হিসেবে তাকে গড়ে তোলা।

গ. কাজে উৎসাহ সৃষ্টি : কর্মমুখী, জীবনসম্পৃক্ত, বৃত্তিমূলক, উপার্জন মনষ্ক জনশক্তি গড়ে তোলা।

এই গুরুত্বপূর্ণ তিনটি লক্ষ অর্জন করতে পারলে বাড়তি জনশক্তি হবে জনসম্পদ আর তা না হলে, আংশিক কর্মমুখী শিক্ষা মানুষকে তৈরি করবে মানবিক মূল্যবোধ বিসর্জিত নিছক যন্ত্রে।

কর্মমুখী শিক্ষার বিদ্যমান সুযোগ : আমাদের দেশে এখনও কর্মমুখী শিক্ষার ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটে নি। ফলে প্রচলিত পন্থায় কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়ে লাখ লাখ উচ্চ শিক্ষিত যুবক-যুবতী বেকারত্বের চরম অভিশাপ নিয়ে দুশ্চিন্তা ও হতাশায় নিমর্জিত। অথচ উন্নত দেশগুলোর শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই কারিগরি, বৃত্তিমূলক ও পেশাভিক্তিক শিক্ষায় শিক্ষিত। এমনকি এশিয়ার দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুর, থাই্যোন্ড, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা ইত্যাদি দ্রুত উন্নয়নশীল দেশে কর্মমুখী শিক্ষা যথেষ্ট গরুদুত্ব পেয়েছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর ৫ শতাংশ কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত। আর বাংলাদেশে এ হার ১ শতাংশেরও কম। এর কারণ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় কর্মমুখী শিক্ষার প্রতি অনভিপ্রেত উপেক্ষা। এমনকি সাম্প্রতিককালে নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, অনেক কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে উন্নীতকরণের যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তাতেও কর্মমুখী শিক্ষার দিকটি যথেষ্ট উপেক্ষিত হয়েছে। এর ফলে অনিবার্যভাবে শিক্ষিত বেকারের সংক্যা আও বাড়ছে। অথচ যদি বৃত্তিমূলক শিক্ষার ক্ষেত্র সম্প্রসারণ করা হতো তবে অনেক তরুণ জীবন-জীবিকার নিশ্চিত অবলম্বনকে আশ্রয় করে সুখ-শান্তিময় ভবিষ্যৎ রচনা করতে সক্ষম হতো।

কর্মমুখী শিক্ষা প্রসারের প্রচেষ্টা : বাংলাদেশে কর্মমুখী শিক্ষার ক্ষেত্র যে একেবারে উন্নয়ন হয় নি তা নয়। বৃত্তিমূলক কারিগরি শিক্ষার কার্যক্রম ক্রমেই সম্প্রসারিত হচ্ছে। দেশে বিভাগ ও জেলা ভেদে প্রকৌশল, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। ২২টি মেডিকেল কলেজ ও ১টি ডেন্টাল কলেজের মাধ্যমে চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষা সম্প্রসারিত হয়েছে। এছাড়াও ৪টি প্রকৌশল ইনস্টিটিউট, অনেকগুলো পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ও ভেকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, লেদার টেকনোলজি কলেজ, টেক্সটাইল টেকনোলজি কলেজ, গ্রাফিক আর্ট ইনস্টিটিউট ইত্যাদির মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত ছোটখাটো কারিগরি প্রতিষ্ঠান দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ও হচ্ছে। তবে সব মিলিয়ে বৃত্তিমূলক শিক্ষার যে সুযোগ এখন বিদ্যমান তা যে বিপুল জনসংখ্যার তুলায় একেবারে নগণ্য তা বলাই বহুল্য।
তবে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার ঘটানোর জন্য সাম্প্রতিককালে সরকার মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরেই কর্মমুখী শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করে এই কার্যক্রমকে বেগবান করার উদ্যোগ নিয়েছেন। কারণ, মাধ্যমিক শিক্ষার ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে দেশের শিক্ষিত জনশক্তি। ইতমধ্যে মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরে কর্মমুখী শিক্ষা প্রসারে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সেগুলো হলো : কৃষিবিজ্ঞান ও গার্হস্থ্য বিজ্ঞানকে বাধ্যতামূলক করণ, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ডাবল শিফট চালু, স্কুল ও মাদ্রাসায় নবম ও দশম শ্রেণিতে বেসিক ট্রেড কোর্স চালু, ১৯৯৫ সাল থেকে সাধারণ শিক্ষা ও ভোকেশনাল শিক্ষা সমন্বয়ে এস. এস. সি. শিক্ষাব্যস্থা চালু, মাধ্যমিক স্তরে ব্যবসা ব্যবস্থাপনা শিক্ষাব্যবস্থা চালু ইত্যাদি।

কর্মমুখী শিক্ষাক্রম বাস্তমায়নের সমস্যা ও সুপারিশ : কর্মমুখী শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনাও অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। প্রয়োজনীয় শিক্ষক, অন্যান্য লোকবল, শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ, আর্থিক ব্যয় সংকুলানের ব্যবস্থা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও প্রকট সমস্যা বিধ্যমান। শিক্ষকদের গুণগত মান উন্নয়নের জন্যে প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তাও অনস্বীকার্য। এসব সমস্যা মোকাবেলার জন্যে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা প্রয়োজন:

১. কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু ও প্রসার করার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক ও মানসম্পন্ন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিত করা।

২. বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার জন্যে শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ করার জন্যে প্রয়োজনীয় ব্যয় বরাদ্দ।

৩. কর্মমুখী শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য শিক্ষকদের ভোকেশনাল শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন এবং

৪. বৃত্তিমূলক শিক্ষা, কারিগরি এবং কম্পিউটার বিজ্ঞান শিক্ষা কার্যক্রমে উৎসাহ তৈরির জন্যে জাতীয় প্রচার মাধ্যমে সৃজনশীল কার্যক্রম প্রচার।

উপসংহার: আমাদের দেশ বাড়তে থাকা বেকার সমস্যাসহ সামাজিক কুসংস্কার, জনসংখ্যা সমস্যা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস ইত্যাদি সমস্যায় জর্জরিত। এই প্রকট সমস্যা কাটিয়ে ওঠার অন্যতম প্রচেষ্টা হিসেবে তরুন সমাজকে উপযুক্ত গঠনমূলক ও কর্মমুখী শিক্ষা প্রদান অত্যন্ত কার্যকরী হবে। এ কাজে ব্যাপক উৎসাহ সৃষ্টি এবং তা বাস্তমায়নের জন্যে দরকার উপযুক্ত বাস্তব ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা এবং প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল। তাহলেই এ মহৎ প্রয়াস জাতীয় জীবনে ইতবাচক ফল বয়ে আনতে সক্ষম হবে।


[ একই রচনা আরেকটি বই থেকে সংগ্রহ করে দেয়া হলো: ]


ভূমিকা : বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব অসীম। সাধারণভাবে আমাদের দেশে শুধু সাধারণ শিক্ষায় ছাত্র-ছাত্রীরা পাস করে যাচ্ছে ফলে বেকারত্বের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত হলে সরকারি চাকুরী না হলেও তারা বেকার থাকবে না। শিক্ষা সমাপ্তির পর তারা নির্দিষ্ট কাজে লেগে জাতি গঠনে এগিয়ে আসতে সাহায্য করবে।

শিক্ষার প্রকারভেদ : সাধারণ অর্থে শিক্ষা দু’প্রকার-
(ক) সাধারণ শিক্ষা
(খ) কারিগরি শিক্ষা।

কারিগরি শিক্ষা কি? : কর্মমুখী শিক্ষা বা কারিগরি শিক্ষা বলতে আমরা সেই শিক্ষাকে বুঝি যা ব্যক্তিকে সংশ্লিষ্ট বৃত্তিমুখী করে তোলে। অর্থাৎ কারিগরি শিক্ষা একজন শিক্ষর্থীকে বাস্তব জীবনক্ষেত্রে একটি বিশেষ পেশার উপযোগী করে তার জীবিকা অর্জনে সহায়তা করে। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ সম্পদ লাভ করে, শিক্ষা মানুষের চিত্তের মুক্তি ঘটায়। জীবনের জন্য উভয়ই প্রয়োজন। কারিগরি শিক্ষা এ প্রয়োজন মেটাতে গভীরভাবে সাহায্য করে।

কারিগরি শিক্ষার বিভিন্ন স্তর : ইঞ্জিনিয়ারিং ও বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক বিষয়ে জ্ঞান লাভ ও যন্ত্রপাতির ব্যবহার এবং নির্মাণের বিদ্যা, ক্ষুদ্র যন্ত্রগুলোর উৎপাদন ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষা বলতে আমরা কারিগরি শিক্ষা বুঝিয়ে থাকি। একদিক থেকে চিকিৎসা বিজ্ঞানও বর্তমান যুগে কিছুটা বৈজ্ঞানিক কারিগরি শিক্ষার মধ্যে পড়ে। কারণ এখানেও যন্ত্রপাতির প্রচলন রয়েছে। শিক্ষাকে জীবনমুখী করার লক্ষ্যে জাতীয় শিক্ষাক্রমে যথেষ্ট পরিমার্জনা করা হচ্ছে। দেশে প্রকৌশল বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করছে। দেশে অনেক চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আছে অনেকগুলো পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট ও ভোকেশনাল ট্রেনিং ইন্সটিটিউট। এছাড়া লেদার টেকনোলজি, টেক্সটাইল ইন্সটিটিউট, গ্রাফিক আর্টস ইন্সটিটিউট এবং এ ধরনের আরও অনেক ট্রেনিং ইন্সটিটিউট।

বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষার আবশ্যিক বিষয়সমূহ : আমাদের মত এমন দরিদ্র দেশে বড় বড় শিল্প-কারখানা ব্যাপকভাবে গড়ে তোলার সুযোগ নেই। তাই এখানে ক্ষুদ্র ও কটির শিল্প প্রতিষ্ঠা করে দেশের বিপুল জনসংখ্যাকে কাজের উপযোগী করে গড়ে তোলা যায়। উচ্চ শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত দরিদ্র ও মেধাহীনদের কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন হাতের কাজ শেখানো যেতে পারে। পাটের ব্যাগ তৈরি, নানা রকম কাগজের ফুল তৈরি, হস্ত ও মৃৎজাত শিল্প, চামড়া, স্ক্রীন প্রিন্ট, বাটিক, ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের কাজ, টিভি, রেডিও, ভিসিপি, ভিসিআর, ফ্রিজ, এয়ারকন্ডিশনিং, বই বাঁধাই, অফসেট মুদ্রণ, কম্পিউটার ইত্যাদি শিখে আজকাল বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন যাপন করা যায়। এছাড়া কাঠমিস্ত্রী, রাজমিস্ত্রী, ইলেকট্রিক মিস্ত্রী, সেনিটারী ফিটিংস, ড্রাইভিং, হোটেল ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদিও বৃত্তিমূলক শিক্ষা হিসেবে গ্রহণ করলে সাধারণ চাকরিজীবীর চেয়ে অনেক ভালভাবে জীবন-যাপন করা যায়।

কারিগরি শিক্ষার কার্যকারিতা : সাধারণ শিক্ষা গ্রহণ করে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাই বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবার লব্ধ শিক্ষাকে কাজে না লাগিয়ে অন্য কোন পেশা অবলম্বন করে শিক্ষাকে অর্থহীন প্রমাণ করা হচ্ছে। তাই সাধারণ শিক্ষার প্রতি আগ্রহ কমিয়ে কারিগরি শিক্ষার প্রতি অনুরাগ দেখাতে হবে। দেশে বিভিন্ন পেশার মধ্যে মূল্য ও মর্যাদার যথেষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান থাকায় শিক্ষিত লোকের দৃষ্টি থাকে উচ্চ মর্যাদার দিকে। তদুপরি বর্তমান বিজ্ঞানের যুগে কারিগরি শিক্ষা ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নতি সম্ভব নয়। যন্ত্র বিজ্ঞানের এ প্রসারের যুগে আমাদের দেশেও কারিগরি শিক্ষার ব্যাপক প্রবর্তন করা উচিত।

শিল্পোন্নয়ন : অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য প্রয়োজন দ্রুত শিল্পায়ন। প্রকৃত শিল্পায়নের জন্য আবার প্রয়োজন কারিগরি শিক্ষা। কারিগরি জ্ঞান না থাকলে কল-কারখানা পরিচালনার কোন যোগ্যতাই জন্মাতে পারে না। তাই সর্বাগ্রে দেশের যুবক যুবতীদের বেশি সংখ্যায় কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে।

প্রয়োজনীয়তা : পুঁথিগত বিদ্যা বাস্তব জীবনে কর্মক্ষেত্রের অনুপযোগী, যে কারণে জাতিগতভাবে আমরা অগ্রসর হতে পারিনি। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ যদি জনশক্তিতে রূপান্তরিত না হয় তাহলে জাতির অগ্রগতি হয় না। জাতীয় জীবনে সমৃদ্ধি আসে না। তাই বর্তমানে বিশেষভাবে প্রয়োজন কারিগরি শিক্ষার।

উপসংহার : আমাদের দেশের অর্থনৈতিক সংকটের মূলে রয়েছে বিপুল জনগোষ্ঠী। এ অবস্থায় এ বিপুল জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করতে পারলে সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। কারিগরি শিক্ষার ব্যাপক সম্প্রসারণ করে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা যায় এবং তা বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন করা যায়। সর্বোপরি কারিগরি শিক্ষা জাতিকে দিতে পারে আত্মকর্মসংস্থানের উপায়।

ভূমিকা : যে-সব গুণ মানব-চরিত্রকে মহিমান্বিত করে তোলে ‘সত্যবাদিতা’ তার মধ্যে একটি মূল্যবান গুণ। সত্যের চেয়ে বড় গুণ আর দ্বিতীয়টি নেই। এই মহাবিশ্ব চির সত্যের ওপর দ-ায়মান। সত্য ও বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে মানুষ তার নিজেকে আবিষ্কার করে, মনুষ্যত্বকে অর্জন করে। তাই মানুষের সাধনা সত্যের সাধনা। সত্যবাদিতার গুণ অর্জন করাই মানুষের নিরন্তর সাধনা হওয়া উচিত। কোন কিছু গোপন না করে অকপটভাবে প্রকাশ করার বৈশিষ্ট্যের নামই সত্যবাদিতা।

বৈশিষ্ট্য : সত্য বলতে কোনো কিছুর যথাযথ প্রকাশ বোঝায়। আর সত্যবাদিতা অর্থ আরও ব্যাপক। শুধু ‘মিথ্যা না বলা’ বোঝাতে সত্যবাদিতা বোঝায় না। সত্যকে অবলম্বন করে যে বৈশিষ্ট্য বিকাশিত হয় তার নাম সত্যবাদিতা। সত্যের মধ্যে কোনো গোপনীয়তা নেই। সত্য জীবনের স্বরূপ বিকশিত করে। সত্যবাদী লোকের কথা ও কাজে কোনো পার্থক্য থাকে না। সত্যবাদিতা মানুষকে খাঁটি সোনার মতো নিখাদ করে তোলে। সত্যের মধ্যে মহান আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হয়। সত্যের মধ্য দিয়েই মানুষ অর্জন করে সততা। সততা মানব চরিত্রের অপার একটি মহৎ গুণ। কোনো প্রকার পাপের কাজ থেকে দূরে থেকে ন্যায় ও সত্যের প্রতিফলন ঘটিয়ে চরিত্রের বিকাশ ঘটাতে পারলে তাতে সততার যথার্থ পরিচয় পাওয়া যায়। তাই যুগে যুগে সত্যের সাধনা চলছে। প্রসঙ্গত কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন-
‘এত সব যার প্রাণ উৎসব সেই আজ শুধু নাই,
সত্য-প্রাণ সে রহিল অমর, মায়া যাহা হল ছাই!
ভুল যাহা ছিল ভেঙে গেল মহাশূন্যে মিলালো ফাঁকা,
সৃজন-দিনের সত্য যে, সে-ই রয়ে গেল চির আঁকা।’



শ্রেষ্ঠ গুণ : সত্যবাদিতা মানবজীবনের একটি শ্রেষ্ঠ গুণ। যে-সব গুণ জীবনকে সার্থক ও বিশিষ্ট করে তোলে তার মধ্যে সত্যবাদিতার স্থান সবার ওপরে। সত্যের অনুসারণে জীবন সুন্দর হয়। সত্যকে অবলম্বন করলে জীবনে সাফল্য অনিবার্য। সত্যবাদী লোক সমাজে সম্মান ও মর্যাদার আসন পান। সবাই তাঁকে বিশ্বাস করে। সকল পাপের উৎস হল মিথ্যা। কেননা মিথ্যা থেকেই শুরু হয় প্রতারণা, জালিয়াতি, শঠতাসহ নানাবিধ কুকর্ম। তাই মিথ্যা বলা মহাপাপ। আর সত্যবাদিতা মানুষের শ্রেষ্ঠ গুণ।

সত্যবাদিতার সুফল ও প্রয়োজনীয়তা : সত্যবাদীকে সবাই বিশ্বাস করে। সমাজে তাঁকে সবাই শ্রদ্ধার চোখে দেখে এবং ভালোবাসে। অপরদিকে মিথ্যাবাদীকে কেউ বিশ্বাস করে না। সমাজে তাকে সবাই ঘৃণার চোখে দেখে। সমাজে সত্যের জয় এবং মিথ্যার পরাজয় নিশ্চিত। সত্যবাদিতা থেকে বিচ্যুত হলে মানুষের নৈতিক অবক্ষয় ঘটে ফলে সমাজ জীবনে অবৈধ কার্যকলাপ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে এবং মানুষের মহৎ গুণাবলির তিরোধান ঘটে। মানুষ তখন নানা অন্যায় কাজে লিপ্ত হয়। সমাজে দেখা দেয় বিশৃঙ্খলা। তাই আদর্শ জীবনযাপনের জন্য সততা ও সত্যবাদিতা অপরিহার্য।

বাস্তব অবস্থা : সততা ও সত্যবাদিতা বাস্তব জীবনের একটি মহত্তর দিক হলেও বাস্তব জীবনে বিশেষত দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে তা যথার্থ মর্যাদা লাভ করতে পারছে না। সততা পরিহার করে মানুষ সত্যপথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে। ফলে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধিকেই তারা প্রাধান্য দিয়ে নানা রকমের অত্যাচার, অনাচার ও দুর্নীতি করে চলেছে। অসততার প্রতি মানুষে তেমন প্রতিবাদ বা বিরূপতা দেখা যাচ্ছে না। সততা বিসর্জন দিয়ে মানুষ এখন নিজের স্বার্থ সাধনে তৎপর। অন্যায় বা অবৈধ পথ অনুসরণ করায় এখন সমাজে এসছে অবক্ষয়। ঘরে-বাইরে সর্বত্রই আজ মনুষ্যত্বের দীনতার চিত্র। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় বড়দের কাছ থেকে ভালো কিছু শেখার আশা করা যায় না। যুব সমাজকে নতুন চেতনায় উদ্দীপ্ত করার মতো আজ কোনো পরিকল্পনা নেই, ফলে তারা প্রতিনিয়ত অবক্ষয়ের দিকে অগ্রসরমান। বস্তুত সমাজের সর্বস্তরে আজ যে সততা, সত্যবাদিতা ও মূল্যবোধের অভাব, তার মারাত্মক প্রতিক্রিয়া যবকদের মাঝে প্রতিনিয়ত বিস্তৃত হচ্ছে।

কর্তব্য : জীবনকে অবশ্যই সত্যবাদিতার মাধুর্যে ম-িত করতে হবে। অন্যায়ের বা অবৈধ উপায়ে যতই বিত্তশালী হোক না কেন তা যে পাপ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অসত্যের পরাজয় আসবেই ও ন্যায়ের পথ চির উজ্জ্বল থাকবেই। সেজন্য সততা ও সত্যবাদিতার অনুশীলন করতে হবে এবং জীবনে তার প্রতিফলন ঘটিয়ে যথার্থ মনুষ্যত্বের অধিকারী হতে হবে।

প্রভাব : মহামানবগণ সত্যের অনুসরণে তাঁদের জীবনের মহান সাধনাকে সফল করেছেন। সত্যবাদিতার জন্য যেমন তাঁরা লক্ষ্য অর্জনে সাফল্যলাভ করেছেন, তেমনি সত্যের বলে বলীয়ান হয়ে তাঁরা প্রবল শত্রুকেও পরাজিত করে নিজেদের প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করেছেন। সত্যের সাধনায় মহাপুরুষগণ জীবনকে যেভাবে গৌরবান্বিত করে গেছেন তা মানুষের কাছে মহান আদর্শ হিসেবে যুগ যুগ ধরে প্রেরণা দেয়।

উপসংহার : সত্যকে যারা মর্যাদা দেয় না তারা উদার হতে পারে না, তাদের মনে চিরদিন ভয় বিরাজ করে। সত্যবাদিতার মহৎ গুণের অভাবে মানুষের মন সব সময়ের জন্য ছোট হয়ে থাকে। অন্যাদিকে সত্যবাদী মানুষ নির্ভীক হয়, দুর্বার সাহস তার মনে বাসা বাঁধে। সে জন্য সত্যের পথ দৃঢ়ভবে আঁকড়ে থাকতে হবে, আর মনে রাখতে হবে কবিগুরুর অমর বাণী:
মুক্ত করো ভয়, আপন মাঝে শক্তি ধরো,
নিজেরে করো জয়,
দুর্বলেরে রক্ষা করো দুর্জনেরে হানো,
নিজেরে দীন নিঃসহায় যেন কভু না জানো।
মুক্ত করো ভয়,
নিজের ‘পরে পরিতে ভয় না রাখে সংশয়।

Author Name

Contact Form

Name

Email *

Message *

Powered by Blogger.