↬ পরিবেশ সংরক্ষণে বনায়ন
↬ পরিবেশ উন্নয়নে বৃক্ষরোপন
↬ গাছ লাগাও, পরিবেশ বাঁচাও
↬ বন সংরক্ষণ
↬ সামাজিক বনায়ন
↬ বৃক্ষরোপন ও বৃক্ষসম্পদ উন্নয়ন
ভূমিকা : প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষরোপণের ভূমিকা যেমন ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী, তেমনি সুষম অর্থনৈতিক উন্নয়নেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিবেশের ভারসাম্য ও সুষম জলবায়ুর প্রয়োজনে একটি দেশের মোট আয়তনের অন্তত ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা আবশ্যক। আমাদের দেশের অর্থনৈতিক ও বিভিন্ন প্রয়োজন মেটাতেও পর্যাপ্ত বৃক্ষ থাকা অতীব প্রয়োজন। বৃক্ষহীনতার কারণে পৃথিবীর নতুন নতুন অঞ্চল মরুময় হয়ে পড়ছে। বিশ্বব্যাংকের মতে, বনের ওপর নির্ভরশীল বিশ্বের প্রায় ৫০ মিলিয়ন মানব জীবন বিকল হতে পারে আগামী শতকের মাঝামাঝিতে। ৩.৫ বিলিয়ন কিউবিক মিটার কাঠ ব্যবহার করে প্রতি বছর ৮ হাজার বর্গহেক্টর বনভূমি ধ্বংস করছে পৃথিবীর মানুষ। বনভূমি ধ্বংস হওয়ার ফলে পৃথিবীর উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব-পশ্চিমের বহু বন্যপ্রাণী ও সামুদ্রিক প্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে। এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার বিস্তৃত এলাকার মরুময়তা রোধে ২০ হাজার হেক্টর ভূমিতে বনায়ন করা অত্যন্ত প্রয়োজন।
বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা : বৃক্ষ মানব জীবনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। আমাদের জীবন ও জীবিকার জন্য বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। বৃক্ষ সমগ্র প্রাণীকুলের খাদ্যের যোগান দেয় এবং সুবিশাল শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে ছায়াদান করে উত্তপ্ত ধরণীকে সুশীতল রাখে। প্রাণীজগৎকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বৃক্ষ অক্সিজেন সরবরাহ করে এবং বাতাস থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে। আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী যেমন আসবাবপত্র, জ্বালানি কাঠ, গৃহনির্মাণ, রেল লাইনের স্লিপার, নৌকা, লঞ্চ, বাঁধ ইত্যাদি নির্মাণ করতে যে বিপুল পরিমাণ কাঠের প্রয়োজন হয় তা বৃক্ষ থেকে আসে। বিভিন্ন শিল্পদ্রব্যের কাঁচামাল যেমন রেয়ন, পেন্সিল, কাগজের মণ্ড, দেশলাইয়ের কাঠি ও বাক্স, কর্পূর, রাবার ইত্যাদি বৃক্ষ থেকে আসে। বনভূমি জীবনরক্ষাকারী ভেষজ ওষুধ তৈরির মূল্যবান উপাদান সরবরাহ করে। বন্যা, খরা ও ঝড় নিয়ন্ত্রণ করে বৃক্ষ প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে। ফলে আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ থাকে। এবং মাটির ক্ষয়রোধ করে মাটিকে উর্বর রাখে। বৃক্ষ গ্রীন হাউজ প্রতিক্রিয়া রোধ করে।
বাংলাদেশে বৃক্ষের অবস্থা : বাংলাদেশে প্রয়োজনের তুলনায় বনভূমি অত্যন্ত কম। তদুপরি জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে বনভূমি কর্তনের মাত্রাও ক্রমে বেড়ে যাচ্ছে। প্রকৃতির ভারসাম্য ঠিক রাখার জন্য কোনো দেশের মোট ভূমির ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা উচিত। প্রাপ্ত তথ্য মতে ১৯৪৭ সালে দেশের আয়তনের ২৪ ভাগ বনভূমি ছিল। ১৯৮০-৮১ সালে তা কমে হয় ১৭.২২ ভাগ এবং বর্তমানে মাত্র ১৭.০৮ ভাগ বনভূমি রয়েছে। এ আশঙ্কাজনক ঘাটতির কারণে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বিবিধ প্রয়োজন মেটানো। এর মধ্যে কৃষি জমির সম্প্রসারণ, বসতবাড়ি স্থাপন, শিল্পে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার, গৃহনির্মাণ সামগ্রী ও আসবাবপত্রের ব্যবহার, রাস্তা, বাঁধসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ, জ্বালানি হিসেবে ব্যাপক ব্যবহার, নগায়ন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। উল্লিখিত কারণগুলোর মধ্যে জ্বালানি হিসেবে বনসম্পদের ব্যবহার ৯৫ শতাংশ দায় ভার বহন করে। এ ছাড়া নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস বৃক্ষের ব্যাপক ক্ষতি করে। অদূর ভবিষ্যতে সাধারণ প্রয়োজনে বৃক্ষ সংকট এক প্রকট সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।
ধ্বংসপ্রাপ্ত বনাঞ্চল এবং বৃক্ষরোপণ : বনভূমি দ্রুত ফুরিয়ে আসায় সারা বিশ্বের জনগণের সচেতনতার সাথে সাথে বাংলাদেশের সরকার ও সচেতন জনগণ বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে এগিয়ে এসেছে। বাংলাদেশের বৃক্ষহীনতায় নিচের দূষণগুলো ঘটছে:
ক. বায়ুদূষণ : বৃক্ষ পরিবেশ থেকে বিষাক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিয়ে অক্সিজেন ফিরিয়ে দেয়। ধোঁয়া ও বালি, ক্লোরোফ্লুরো কার্বন, ধাতব কণা, আয়নাইজিং বিকিরণ, আগাছানাশক, কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক, কার্বন ডাই-অক্সাইড, তেজস্ক্রিয় পদার্থ ইত্যাদি হলো বায়ুদূষণের উৎস। ঢাকা শহরে সিসা, কার্বনমনোক্সাইড, হাইড্রোকার্বন প্রভৃতি উপাদান বাতাসে বিষাক্ততা ছড়িয়ে দিয়েছে। এ কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস শরীরে ঢুকে রক্তের হিমোগ্লোবিনের সাথে মিশে অক্সিজেনের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। হাইড্রোকার্বন যকৃতের ক্যান্সার ঘটায়। বাতাসে বিদ্যমান বিভিন্ন ধূলিকণা শ্বাসকষ্ট ও এলার্জির কারণ। সালফার ডাই-অক্সাইড বিভিন্ন ধরনের শস্যের ক্ষতি করে। এসিড বৃষ্টির ফলে মাটিতে পানির PH হ্রাস পায় এবং উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও বিকাশে ব্যাঘাত ঘটায়। এ দূষণের হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে পর্যাপ্ত সংখ্যক সবুজ উদ্ভিদ রোপণ করতে হবে।
খ. গ্রিন হাউস ইফেক্ট : গ্রিন হাউস অর্থ হলো সবুজ ঘর। মূলত এটা একটা কাচের ঘর যার মধ্যে তাপ সংরক্ষণ করে সবুজ গাছপালা জন্মানো হয়। বিজ্ঞানীরা ধারণা করেছেন, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে তাপ অপরিবাহী গ্যাসের আবষ্টেনীর জন্য সূর্য থেকে প্রাপ্ত তাপ ধরে রাখার মতো গ্যাসীয় আবরণ সৃষ্টি হয়েছে। এ গ্রাসীয় আবরণ গ্রিন হাউসের কাচের মতো কাজ করে। এ তাপ ধারণ অবস্থা যখন নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করে তখন তা জীবকুলের জন্য বিপজ্জনক হয়ে পড়ে। কাচের দেয়াল ও ছাদবিশিষ্ট গ্রিন হাউসের ভেতরের উত্তাপ কাচের ভেতর দিয়ে বাইরে যেতে পারে না। গ্রিন হাউসের কাচ যেমন প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে, তেমনি কার্বন ডাই-অক্সাইড, সিএফসি, নাইট্রাস অক্সাইড, মিথেন ইত্যাদি গ্যাসে তাপ বিকিরণে প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠে। বিজ্ঞানীদের মতে, ২০৮০ সালে বিশ্বের তাপমাত্র ৫ ডিগ্রি বৃদ্ধি পাবে, আর্কটিক মহাদেশের বিশাল বরফস্তর ক্ষয়ে যাবে যার ফলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়বে। সমুদ্রে পানির উচ্চতা ১ মিটার বাড়লে পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ অর্থাৎ মালদ্বীপ, বাংলাদেশসহ বহু দেশ ১০ ফুট পানির নিচে তালিয়ে যাবে। গ্রিন হাউস ইফেক্ট থেকে রক্ষা পেতে বৃক্ষ কাটা রোধ ও বৃক্ষরোপণ করতে হবে। নতুবা এর পরিণাম হবে ভয়াবহ।
গ. ভূমিক্ষয় : বৃক্ষহীনতার কারণে অনবরত ভূমিক্ষয় বাড়ছে, নদীর ভাঙন বৃদ্ধি পেয়েছে। বনভূমি ধ্বংসের ফলে ভূমিক্ষয়ের প্রবণতা বাড়ে এবং খরা ও মরুকরণ ত্বরান্বিত হয়। ড. তারক মোহন দাসের মতে, একটা গাছ তার পঞ্চাস বছর জীবনকালে প্রায় দুই লাভ পঞ্চাস হাজার টাকার মূল্যের মাটির ক্ষয় উর্বরতা বৃদ্ধি করে। তাই ভূমিক্ষয় রোধে বৃক্ষরোপণ আশু প্রয়োজন।
ঘ. প্রাকৃতিক দুর্যোগ : বাংলাদেশে উপকূলীয় দুর্যোগ বৃদ্ধি পেয়েছে উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনীহীনতার কারণে। বাংলাদেশের সুন্দরবন ও বান্দরবান দুর্যোগের বিরুদ্ধে অতন্দ্র প্রহরী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
পরিবেশ দূষণ রোধে উদ্ভিদ : পরিবেশকে দূষণমুক্ত করতে উদ্ভিদ বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। প্রাণীজগৎ শ্বাস-প্রশ্বাস ও দহনকার্যের ফলে প্রচুর পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়মণ্ডলে যোগ করছ এবং সেখান থেকে প্রচুর পরিমাণ অক্সিজেন গ্রহণ করছে। প্রাণীজগৎ যেমন বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি করছে, অন্যদিকে অক্সিজেনের পরিমাণ হ্রাস করছে। সবুজ উদ্ভিদ বায়ুমণ্ডলের এ ভয়াবহতা দূর করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে। সবুজ উদ্ভিদ বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ হ্রাস করে পরিবেশকে দূষণমুক্ত করে। উদ্ভিদ মাটিকে দৃঢ়ভাবে আটকে রেখে মাটির ক্ষয়রোধ করে। গ্রীন হাউস ইফেক্ট থেকে রক্ষা পেতে হলে উদ্ভিদ রোপণ করতে হবে।
বনজসম্পদ উন্নয়ন : বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বনজসম্পদের গুরুত্ব অপরিসীম কিন্তু পরিতাপের বিষয়, বাংলাদেশে প্রয়োজনের তুলনায় বনভূমি খুবই কম। নির্বিচারে বৃক্ষকর্তনের ফলে আমাদের বনভূমি সংকুচিত হয়ে আসছে। আমাদের বনভূমি সংকুচিত হয়ে বর্তমানে মোট স্থলভাগের শতকরা ১৭.০৮ ভাগে এসে দাঁড়িয়েছে। আমাদের অর্থনীতির উন্নয়নের স্বার্থে বাংলাদেশের বনজসম্পদের উন্নয়ন ও সংরক্ষণ দরকার। নিম্নবর্ণিত উপায়ে বাংলাদেশের বনজসম্পদের উন্নয়ন করা যেতে পারে :
নতুন বনভূমি সৃষ্টি : বাংলাদেশের নদীতীর, উপত্যকা, পাহাড়ি উচ্চ অঞ্চল এবং সমুদ্র উপকূলে বনভূমি গড়ে তুললে বনাঞ্চল বৃদ্ধি পাবে।
নির্বিচারে বৃক্ষকর্তন রোধ : আমাদের বনজসম্পদের ওপর মানুষের বেপরোয়া হামলা চলছে। নির্বিচারে বৃক্ষকর্তন রোধ করে বিনষ্ট হয়ে যাওয়া বনকে পুনরায় সজীব করে তোলার সার্বিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
আবাদযোগ্য জমি সৃষ্টি রোধ : মানুষ আবাদযোগ্য জমি সৃষ্টি করতে নির্বিচ্চারে বৃক্ষকর্তন করে চলছে, বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে এটি রোধ করতে হবে।
জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি : বণাঞ্চলের অর্থনৈতিক ও প্রাকৃতিক গুরুত্ব সম্পর্কে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করে বিনামূল্যে বিভিন্ন জাতের চারাগাছ সরবরাহ করতে পারলে বনায়ন প্রক্রিয়া জোরদার হবে।
বনজসম্পদ উন্নয়নে সরকারি ব্যবস্থা : বাংলাদেশ সরকার দেশের বনজসম্পদের গুরুত্বের পরিপ্রেক্ষিতে এর উন্নয়ন ও সংরক্ষণের বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। বনজসম্পদের উন্নয়ন ও তার সুষ্ঠু ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশে বনশিল্প উন্নয়ন সংস্থা গঠন করা হয়েছে। তাছাড়া বন গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়েছে এবং বনবিষয়ক শিক্ষা প্রদানের জন্য সিলেটে একটি বন মহাবিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে বনজসম্পদের ওপর স্নাতন ডিগ্রি প্রদান করা শুরু করেছে।
বৃক্ষসম্পদ উন্নয়নে করণীয় : বৃক্ষসম্পদ বৃদ্ধিতে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে :
১. সামাজিক বনায়নের জন্য নতুন এলাকা বেছে নিতে হবে। যেমন নদীর ধার, পাহাড়ের ঢাল, উপকূল, রেল ও সড়কের পাশে অধিক হারে গাছ লাগাতে হবে।
২. বনভূমি থেকে কাঠ সংগ্রহের জন্য আর কোনো গাছ যেন না কাটা হয় সে ব্যবস্থা নিতে হবে। গাছ কাটা হলে পুনরায় নতুন চারা রোপণ করে শূন্যতা পূরণ করতে হবে।
৩. বনভূমির নতুন নতুন এলাকাকে অভয়ারণ্য হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। পার্শ্ববর্তী দেশে নতুন নতুন বন সৃষ্টি করে তা অভয়ারণ্য হিসেবে চিহ্নিত করে প্রাণীদের রক্ষায় যে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে আমাদের দেশেও সে ব্যবস্থা নিতে হবে।
৪. সরকারিভাবে বনায়নের যে উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে তা দূর করতে হবে। বনভূমি সংরক্ষণের জন্য এগিয়ে আসতে হবে।
উপসংহার : বৃক্ষরোপণ বা বৃক্ষসম্পদের উন্নয়ন আমাদের অস্তিত্বের জন্যই জরুরি। পাশাপাশি এটি অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক, কাজেই কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়। আমাদেরকে আন্তরিকভাবেই বনজসম্পদের উন্নয়নে উদ্যোগী হতে হবে। কেবল সরকারি বা এনজিও পর্যায়ে নয়, এ ব্যাপারে আমাদের পারিবারিক ও ব্যক্তিগতভাবেও উদ্যোগী হতে হবে।
[ একই রচনা আরেকটি বই থেকে সংগ্রহ করে দেয়া হলো: ]
ভূমিকা:
“বৃক্ষ নেই, প্রাণের অস্তিত্ব নেই, বৃক্ষহীন পৃথিবী যেন প্রাণহীন মহাশ্মশান।”
অফুরন্ত সৌন্দর্যের এক মধুর নিকুঞ্জ আমাদের এ পৃথিবী। এই পৃথিবীকে সবুজে-শ্যামলে ভরে দিয়েছে প্রাণপ্রদায়ী বৃরাজি। এ বিশ্বকে সুশীতল ও বাসযোগ্য করে রাখার ক্ষেত্রে বৃক্ষের অবদান অনস্বীকার্য। আবার মানুষের সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্যে যেসব মৌলিক চাহিদা রয়েছে তার অধিকাংশই পূরণ করে বৃক্ষ। তাই মানবজীবনে বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা অপরীসীম।
“দাও ফিরিয়ে সে অরণ্য, লও এ নগর”
-কবির এ আর্তি আজ অরণ্যে রোদনে পরিণত হয়েছে। কেননা অরণ্য দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে মানুষের কুঠারের আঘাতে। এ হচ্ছে মানুষের আত্মঘাতি কর্ম।
বাংলাদেশের বনাঞ্চল: প্রাকৃতিক লীলা বৈচিত্রের এ দেশে বনভূমি সৃষ্টি হয়েছে বিচিত্র রূপে। বাংলাদেশের বনাঞ্চলকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা:
১. ক্রান্তীয় চিরহরিৎ বনভূমি
২. শালবন বনভূমি ও
৩. স্রোতজ বনভূমি
চট্টগ্রাম, পার্বত্য জেলাসমূহ ও সিলেট অঞ্চলে পনের হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে রয়েছে ক্রান্তীয় চিরহরিৎ বনভূমি। ভাওয়াল ও মধুপুরের এক হাজার বর্গকিলোমিটার এবং ময়মনসিংহ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, রংপুর, দিনাজপুর, কুমিল্লার বিশাল এলাকা জুড়ে রয়েছে শালবন। আর দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সমুদ্র উপকূলবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বিরাজমান সুন্দরবন-ই হচ্ছে স্রোতজ বনভূমি।
বাংলাদেশের বনভূমির পরিমাণ: একটি দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্যে মোট ভূমির শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, আমাদের দেশে মোট ভূমির মাত্র ১৬ ভাগ বনভূমি রয়েছে যা দেশের প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। তবে এটি সরকারি হিসেবে, প্রকৃত-প্রস্তাবে বনভূমির পরিমাণ মাত্র ৯%, আর World Research Institute এর মতে মাত্র ৫%। দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বনভূমির পরিমাণ মাত্র ৩.৫%। তাই ইতমধ্যেই বাংলাদেশে প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। দেশে সময়মতো বৃষ্টিপাত হচ্ছে না এবং অসময়ে প্রচুর বৃষ্টিপাত, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি নেত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এভাবে নির্বিচারে বৃক্ষনিধনের ফলে শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বপরিবেশে দেখা দিয়েছে গ্রীনহাউজ প্রতিক্রিয়া।
বনায়ন বা বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা: World Research Institute এর মতে, বিশ্বের বনভূমি উজাড় হতে হতে অর্ধেকে এসে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে বিশ্ব পরিবেশ হুমকির মুখে পড়েছে। মানুষ ও প্রাণীর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বৃক্ষের ব্যাপক আবশ্যকতা রয়েছে। তাই বৃক্ষকে মানবজীবনের ছায়াস্বরূপ বলা হয়। বৃক্ষ আমাদের নীরব বন্ধু, সে আমাদেরকে প্রতিনিয়ত কত যে উপকার করছে তা একবার ভেবে দেখলে অনুধাবন করা যায়। প্রত্যক্ষ বা পরোভাবে বৃক্ষই আমাদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছে। নিচে বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তার কয়েকটি দিক উল্লেখ করা হল:
- বৃক্ষ প্রাণীজগৎকে খাদ্য দেয়। মানুষ ও পশু-পাখি বৃক্ষের ফুল-ফল এবং লতা-পাতা খেয়ে জীবন ধারণ করে।
- বৃক্ষ সকল প্রাণিকুলের ত্যাগ করা বিষাক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে আর দেয় জীবন রক্ষাকারী অক্সিজেন। ফলে প্রাণীরা এ জগতে বেঁচে থাকতে পারে।
- আমরা তাপ উৎপাদন, রন্ধন এবং অন্যান্য জ্বালানি কাঠ বৃক্ষ হতে পেয়ে থাকি।
- আসবাবপত্র, গৃহ, নৌকা, জাহাজ, বাঁধ, সেতু ইত্যাদি নির্মাণে বৃক্ষ আমাদের কাঠ দেয়।
- বৃক্ষ থেকে কাগজের মন্ড এবং রেয়ন শিল্পের কাঁচামাল ও দিয়াশলাই তৈরি হয়।
- বনভূমি থেকে মধু ও মোম সংগ্রহ করা হয়।
- গাছপালা দেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ করে।
- গাছপালা জমির উর্বরতা-শাক্তি বৃদ্ধি করে অধিক উৎপাদনে সাহায্য করে।
- গাছপালা নদীর ভাঙন, বৃষ্টিপাত ও পানি-স্ফীতির হাত থেকে রক্ষা করে। এতে মাটিতে স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।
- বৃক্ষাদি ঝড়-ঝঞ্ঝা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে বাসগৃহকে রাক্ষা করে।
- বৃক্ষ আমাদের জীবন রক্ষার নানা ওষুধ দান করে।
বৃক্ষরোপণ অভিযান: বনজ সম্পদকে টিকিয়ে রাখা ও এর সম্প্রসারণের জন্যে আমাদের দেশে প্রতিবছর বৃক্ষরোপন অভিযান পরিচালনা করা হয়। সপ্তাহ, পক্ষকাল বা মাসব্যাপী এ অভিযান চলে। এ সময় পরিকল্পিত উপায়ে বৃক্ষরোপণ করা হয়। সাধারণত প্রতি বছর বর্ষাকালে সরকারের বনবিভাগের উদ্যোগে বৃক্ষরোপণ অভিযান চালানো হয়। এ সময় জনগণ নিকটস্থ নার্সারী থেকে বিনামূল্যে অথবা স্বল্প মূল্যে গাছের চারা সংগ্রহ করতে পারে। অভিযান চলাকালে আমাদের জীবনে বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা ও চারা রোপণের পদ্ধতি সম্পর্কে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে শিক্ষা দেয়া হয়। নিঃসন্দেহে বৃক্ষরোপণ অভিযান একটি মহৎ প্রচেষ্টা।
বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি ও গৃহীত পদপে: ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন করে আসছে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বন অধিদপ্তর কর্তৃক ১৯৮২ সালে উত্তরাঞ্চলের বৃহত্তর রাজশাহী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলায় গৃহীত ‘কমিউনিটি বনায়ন’ কর্মসূচি। ৭ হাজার গ্রামকে এই কর্মসূচির আওতায় আনা হয়। ১৯৮৭-৮৮ সালে দেশের ৬১ জেলায় ‘থানা বনায়ন ও নার্সারি উন্নয়ন প্রকল্প’ হাতে নেওয়া হয় এবং বনায়ন সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির জন্যে ৮০ হাজার ব্যক্তিকে বিভিন্ন মেয়াদে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় আর জনসাধারণের মধ্যে ৬ কোটি চারা বিতরণ করা হয়। উপকূলীয় চরাঞ্চলে, সব কটি মহাসড়কের দুপাশে, রেল সড়কের ধারে এবং বাঁধ এলাকায় এই বনায়নে ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেছে। ১৯৯৬ সালে উপকূলীয় দ্বীপাঞ্চলের ম্যনগ্রোভ গাছপালা লাগানো শুরু হওয়ার পর ইতোমধ্যে ১ লক্ষ ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে বনায়ন সম্পন্ন হয়েছে। সরকার বনায়ন বৃদ্ধিতে এখনো নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে যাচ্ছে।
বনায়নের উপায় : বাংলাদেশে বনায়নের সম্ভাবনা বিপুল। নানাভাবে এ বনায়ন সম্ভব। একটি পন্থা হলো : সামাজিক বন উন্নয়ন কর্মসূচি। এর লক্ষ্য হলো : রাস্তার পাশে বৃক্ষরোপণে জনসাধারণকে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করানো। জনগণ যাতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ কর্মসূচিতে যোগ দেয় সেজন্যে অর্থনৈতিক প্রণোদনা থাকতে হবে। তাছাড়া নানা জাতের বৃক্ষ মিশ্রণ করে রোপণ করতে হবে যেন গ্রামবাসীরা খাদ্য, ফল, জ্বালানী ইত্যাদি আহরণ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে আর একটি বিকল্প হচ্ছে, বনায়ন কর্মীদের অতিরিক্ত আয়ের উৎস প্রদান করা। এছাড়া সরাসরি ঋণ, ভর্তুকি এবং অনুদান প্রদান, বিনামূল্যে বীজ ও চারা সরবরাহ, বনায়ন-বৃক্ষায়ণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি, সার, খাদ্য ইত্যাদি সাহায্য, ফসল ভাগাভাগিকরণ ইত্যাদি ব্যবস্থা করা। ওয়ার্ড মেম্বারের নেতৃত্বে এবং শিক্ষক, সমাজকর্মী, মসজিদের ইমাম প্রমুখের সমন্বয়ে গঠিত গ্রাম সংস্থা এই বনায়নের প্রয়োজনীয়তা পূরণ করতে পারে। এ সংস্থা সরকারি-বেসরকারি দপ্তরের সাথে সামাজিক বনায়ন-বৃক্ষায়ণ সম্পর্কিত সকল বিষয় তদারক করবে এবং গ্রামের জনসাধারণকে পরিবার ভিত্তিতে বনায়নের কাজে সম্পৃক্ত করবে। যেমন- বাঁধ, সড়ক, রেলপথ, খালের পাড়, খাস পুকুর পাড়, খাস জমি ইত্যাদির আশেপাশে যেসব পরিবার বাস করে তারা নির্দিষ্ট পরিমাণ জায়গা বরাদ্দ পাবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী এবং সরকারি-বেসরকারি সহায়তার আওতায় তারা বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যার ভার গ্রহণ করবে এবং এ থেকে যে আয় হবে নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী সে আয়ের অংশ তারা পাবে। এভাবে যেসব পরিবার খালি জায়গা পাহাড়-পর্বতের আশেপাশে থাকে তাদেরকে সেখানে বনায়নে সম্পৃক্ত করা হবে।
বৃক্ষহীনতার অপকারিতা: বৃক্ষশূন্যতা যে কী ভয়াবহ তার জ্বলন্ত উদাহরণ আফ্রিকার অঞ্চল। বৃক্ষশূন্য, পানিশূন্য এলাকার মানুষ চলে গেছে অন্য এলাকায়। বাংলাদেশেও এর অশুভ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস তো লেগেই আছে। নির্বিচারে বৃক্ষনিধনের ফলে শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বপরিবেশে দেখা দিয়েছে গীনহাউজ প্রতিক্রিয়া। বিশ্বপরিবেশ আজ বিপর্যস্ত ও হুমকির সম্মুখীন।
উপসংহার: অস্বীকার করার উপায় নেই যে, কেবল বৃক্ষরোপণ সপ্তাহ পালন করে সরকারিভাবে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে জনসেবা করলেই দেশ সবুজ হয়ে যাবে না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই এ কর্মসূচি পালন করে আসা হচ্ছে। অথচ বৃক্ষরোপণ অভিযান এখনো আশানুরূপ নয়। একে সফল করতে হলে দেশব্যাপী ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। এমনকি স্কুল-কলেজে পাঠ্য পুস্তকে এর গুরুত্ব নির্দেশ করে আরো অধিক হারে প্রবন্ধ রচনা করা প্রয়োজন।
উৎস:
১. বন, বনবিনাশ ও বনবাসীর জীবন সংগ্রাম, ফিলিপ গাইন, সেড, ঢাকা, বাংলাদেশ।
২. পরিবেশপত্র, ৫-১২তম সংখ্যা।
৩. গণ উন্নয়ন গ্রন্থাগার : পরিবেশ ও উন্নয়ন, বুলেটিন ৪২।