April 2020

ভূমিকা : চরিত্র এমন একটি শক্তি, ব্যক্তিত্বের এমন একটি দিক যা ন্যায় নীতি ও নৈতিক জীবনাচরণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত। একজন মানুষের স্বভাবে ভালো-মন্দ দুটো দিকই থাকতে পারে। মন্দের পাল্লা ভারি হলে সে দুশ্চরিত্র বলেই পরিচিত হয়। অন্যদিকে সৎ চরিত্রের অধিকারী বলতে আমরা বুঝি তিনি ন্যায়বান ও সুবিবেচক। অন্তর শক্তির দৃঢ়তা, অধ্যাবসায় ইত্যাদিও সুচরিত্রের অঙ্গ। চরিত্র অনুযায়ী গঠিত হয় ব্যক্তিজীবন যার প্রভাব গড়ে পরিবেশ ও সমাজ জীবনের ওপর।

চরিত্র কী : চরিত্র শব্দটি ইংরেজি ‘Character’ শব্দের প্রতিশব্দ হলেও মূলত তা এসেছে গ্রিক থেকে। আদিতে এর অর্থ ‘চিহ্ন’ হলেও প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে থেকে শব্দটি ব্যক্তির আচরণ ও আদর্শের উৎকর্ষবাচক গুণ বোঝাতেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
চরিত্র গঠনের দুটো দিক রয়েছে। সচ্চরিত্র ও দুশ্চরিত্র। উৎকর্ষবাচক নানা গুণের সমন্বয়ে গঠিত চরিত্র সচ্চরিত্র। আর মানুষের মধ্যে লুকানো অপকর্ষ বা পশুত্ব যদি হয় চরিত্রের মূল বৈশিষ্ট্য তবে সেই চরিত্রই দুশ্চরিত্র। চরিত্র মানবজীবনের এক মহামুল্যবান অবিনাশী সম্পদ। যিনি সৎ চরিত্রের অধিকারী তিনি সমাজের শ্রেষ্ঠ অলঙ্কার ও প্রজ্বলিত দীপশিখা। এ কারণেই চরিত্রকে জীবনের মুকুট বলা হয়। মুকুট যেমন সম্রাটের শোভা বর্ধন করে, তেমনি চরিত্র মানবজীবনের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। সততা, সহৃদয়তা, সংবেদনশীলতা, ন্যায়পরায়ণতা, ক্ষমা, ঔদার্য, কর্তব্যপরায়ণতা, গুরুজনে ভক্তি, মনবিকতা ও আত্মসংযম ইত্যাদি সচ্চরিত্রের লক্ষণ। যিনি চরিত্রবান তিনি কখনও সত্য পথ থেকে বিচ্যুত হন না, অন্যায়কে প্রশ্রয় দেন না। তিনি সযত্নে ক্রোধ, অহঙ্কার, রূঢ়তা ইত্যাদিকে পরিহার করেন। তিনি হন সত্যবাদী, সংযমী ও ন্যায়পরায়ণ। যাবতীয় মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটে বলে চরিত্রবান মানুষ জাতির সম্পদ।

চরিত্র ঘঠনের গুরুত্ব : মানুষের জীবনে চরিত্রে মূল্য ও গুরুত্ব কতখানি তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। কেবল চরিত্রের শক্তিতে ও প্রভাবে মানুষ হতে পারে বিশ্ববরেণ্য ও চিরস্মরণীয়। বিদ্যার মূল্য মানবজীবনে অপরিসীম। কিন্তু বিদ্যার চেয়ে চরিত্রকেই অনেক সময়ে দেওয়া হয় অধিকতর গুরুত্ব। প্রবাদ আছে-
‘দুর্জন বিদ্যান হলেও পরিত্যাজ্য।’

কারণ, বিদ্যান লোক দুর্জন হলে তা সমাজের কল্যাণ না হয়ে অকল্যাণই হয় বেশি। এ প্রসঙ্গে একটি সুভাষিত স্মরণীয় উক্তি :
‘অমরত্বের সুধা পান না করেও মানুষ অমর হতে পারে কেবল চরিত্রের গুণে।”

তাই চরিত্রের বিকাশ সাধনই মানুষের লক্ষ্য হওয়া উচিত। পৃথিবীতে নিজেকে খাঁটি ও উন্নত করে গড়ে তোলাই মানুষের কাম্য। চরিত্রের মাধ্যমে মানুষের জীবন পদ্ধতিই কেবল নির্ধারিত হয় না, চরিত্রই এক অর্থে মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করে।

চরিত্র গঠন-মূলক শিক্ষার লক্ষ্য : চরিত্র গঠনমূলক শিক্ষার লক্ষ্য হচ্ছে, যুক্তির শক্তিতে সমাজস্বীকৃত আচরণ অনুসরণে ব্যক্তির ইচ্ছা ও সামর্থ্যকে বিকশিত করা। ব্যক্তির চারিত্রিক গুণাবলি বিকাশের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত দিকগুলো শিক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্ব পাওয়া প্রয়োজন।

১. মানবিক গুণাবলির সমাহার হিসেবে ধৈর্য, সাহস, আনুগত্য, সততা, সৌজন্য, নির্ভরযোগ্যতা, কৃতজ্ঞবোধ, সহজ অমায়িকতা, পরহিতব্রত ইত্যাদি গুণাবলি;
২. শৃঙ্খলা, সময়ানুবর্তিতা, পরমত সহিষ্ণুতা, শিষ্টাচার ইত্যাদি সামগ্রিক আচার-আচরণ-অভ্যাস;
৩. দেশপ্রেম, অসাম্প্রদায়িকতা, জাতীয়তাবোধ, আন্তর্জাতিক সৌভ্রাতৃত্ব, মানবপ্রেম ইত্যাদি সংগঠিত ভাবাবেগ;
৪. হিংসা, বিদ্বেষ, কুটিলতা ইত্যাদি মানসিতা পরিহার এবং বদ অভ্যাস বা প্রবৃত্তি দমন;
৫. ন্যায়বিচার, মানবকল্যাণ, পরহিতব্রত ইত্যাদি মানবিক গুণাবলিকে জীবনের চালিকা শক্তি হিসেবে গ্রহণ।
শিক্ষার মাধ্যমে চরিত্র গঠনের পদ্ধতি : দেশ ভেদে কাল ভেদে চরিত্র গঠনমূলক শিক্ষায় ধারণা, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে পার্থক্য দেখা যায়। তা সত্ত্বেও বলা যায়, সুপ্রাচীন কাল থেকেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় চরিত্র গঠনের উপর বিশেষ গরুত্ব আরোপ করা হয়ে আসছে। এক্ষেত্রে দুটি পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়ে থাকে; প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ। প্রত্যক্ষ পদ্ধতিতে গুরুত্ব পায় : ন্যায়নীতি শিক্ষা, নৈতিক মান গঠন; কাজ, সততা, সৌন্দর্য, সৌজন্য, কৃতজ্ঞাবোধ ইত্যাদি গুণাবলির প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি; পশুপাখির প্রতি মমত্ব ও পরিবেশ রক্ষায় সচেতনতা সৃষ্টি। সামগ্রিকভাবে প্রত্যক্ষ পদ্ধতির লক্ষ্য হচ্ছে ব্যক্তির চারিত্রিক গুণাবলি ও সুঅভ্যাস গড়ে তোলায় সহায়তা দান।
চরিত্র গঠনমূলক শিক্ষার পরোক্ষ পদ্ধতি হচ্ছে ইতিহাস, জীবন ও সাহিত্য থেকে পাঠের মাধ্যমে দৈনন্দিন আচরণ ও মূল্যবোধ সৃষ্টি। এভাবে মহৎ চরিত্র সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের মনে আদর্শ ধারণা সৃষ্টি করা হয়।
চরিত্র গঠনে বাবা-মা, পাড়া-প্রতিবেশীর ভূমিকা ছাড়াও বয় স্কাউট, গার্ল গাইড, রেডক্রস ইত্যাদি সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা গুরুত্বপূর্ণ। স্বেচ্ছা সংগঠনের মাধ্যমে মানুষ যৌথ কাজের গুরুত্ব ও আনন্দ অনুভব করতে পারে।

শিশু বয়সে চরিত্র গঠন : শিশুর চরিত্র যেন নির্মল ও স্বচ্ছ হয় সেজন্যে উপযুক্ত শিক্ষাদানে অভিভাবকদের পাশাপাশি তৈরি করতে হয় অনুকূল পরিবেশ। শিশুকে সৃষ্টিশীল কাজে উৎসাহিত করা হলে তাতে সৃজনী প্রতিভা বিকশিত হয়। শিশুর জীবনে মহৎ গুণের সমাবেশ ঘটাতে হলে চাই সৎ সঙ্গ। পিতামাতা, সঙ্গীসাথী, আত্মীয়-পরিজন সৎ চরিত্রের অধিকারী না হলে এদের সাহচর্যে শিশুর মধ্যে সচ্চরিত্রের গুণগুলো সুদৃঢ় ভিত্তি পেতে পারে না।
পারিবারিক পরিবেশ ছাড়াও শিশুর নৈতিক বিকাশে বিদ্যালয় জীবন ও শিক্ষক-শিক্ষিকার প্রভাব গরুত্বপূর্ণ। শিক্ষকের কাজ শিশুকে সুশিক্ষা দেওয়া। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে মহৎ গুণের সমাবেশ ঘটানোর গুরুদায়িত্ব তাঁদেরই। আজকাল শিশুর ভালো-মন্দ চরিত্র গঠনে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখছে টেলিভিশন ও স্যাটেলাইট চ্যানেলের মতো গণমাধ্যম। স্যাটেলাইটের বিভিন্ন চ্যানেলে যেসব অনুষ্ঠান প্রচার করা হয় তার মধ্যে এমন অনুষ্ঠানও থাকে যা শিশুর জন্যে অনুপযোগী। শিশুস্বভাবতই টেলিভিশনের অনুষ্ঠানের প্রতি আকৃষ্ট হয়। তাই অভিভাবককে অবশ্যই দৃষ্টি দিতে হবে যাতে তাদের শিশুদের চরিত্রের ওপর অপকৃষ্ট অনুষ্ঠানের কুপ্রভাব না পড়ে। এ কারণে খুন-জখম, মারামরি ও স্থুল বিকৃত রুচির বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান শিশুর চরিত্র গঠনের ক্ষেত্রের ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। তাই এ ধরণের অনুষ্ঠান দেখা থেকে শিশুকে বিরত রাখতে হবে।
তবে সর্বোপরি যে জিনিসটির ওপর অভিভাবককে বিশেষ সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে তা হলো সৎ সঙ্গ। কুসঙ্গের পাল্লায় পড়ে অনেক সম্ভাবনাময় প্রতিভা অকালে ঝরে পড়ে, হারিয়ে যায় অন্ধকারে। এ সম্পর্কে প্রবাদ আছে- ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।’ তাই শিশুর সঙ্গী ও বন্ধু নির্বাচনে অভিভাবকের সতর্ক বিবেচনা দরকার।

চরিত্র গঠনের সাধনা : চরিত্র গঠনের জন্যে ব্যক্তির নিজস্ব সাধনাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। লোভ লালসা ও অসৎ প্রবৃত্তির নানা কুপ্রলোভন মানুষকে পাপের পথে টানে। এসব পাপ পথ সতর্ক ও দৃঢ়চিত্তে পরিহার করে লোভকে জয় করার শক্তি অর্জন করে চরিত্রবানের আদর্শকে মশাল হিসেবে জ্বালিয়ে উন্নত জীবনের সাধনায় নিযুক্ত হলেই সুচরিত্র গঠনে এগিয়ে যাওয়া যায়। কেবল তাই নয়, চরিত্র রক্ষার জন্যেও মানুষকে আমৃত্যু নিরন্তর সাধনা করে যেতে হবে। ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে-
When money is lost nothing is lost
When health is lost something is lost
When character is lost everything is lost.

অর্থাৎ টাকা হারালে টাকা অর্জন করা যায়, স্বাস্থ্য হারালে তাও পুনরুদ্ধার করা যায়, কিন্তু চরিত্র হারালে তা আর ফিরে পাওয়া যায় না। তাই মনুষ্যত্বের অধিকারী হবার জন্যে গড়ে তুলতে হবে সুন্দর, নির্মল ও পরিচ্ছন্ন চরিত্র।

মহৎ চরিত্রের দৃষ্টান্ত : পৃথিবীতে যারা চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন তাঁরা ছিলেন চরিত্র শক্তিতে বলীয়ান। কোনো প্রলোভনই তাদেরকে ন্যায় ও সত্যের পথে বিচ্যুত করতে পারে নি। এমনই চরিত্রের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.)। তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন অন্যায়, অসত্য ও পাপের বিরুদ্ধে। যুগে যুগে সকলেই ছিলেন মানবব্রতী, ছিলেন উত্তম চরিত্রের অধিকারী। বিদ্যাসাগর, রামমোহন, রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা গান্ধী, শেরে বাংলা ফজলুল হক, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, মওলানা ভাসানীর মতো মানবব্রতী, সমাজব্রতী, দেশব্রতী মহাপ্রাণ সকলেই ছলেন উন্নত ও মহৎ চরিত্রের অধিকারী। এমনি আরো অনেক মহৎ চরিত্রের মৃত্যুতে বিশ্বের মানুষ অশ্রুজল ফেলেছে। তাঁদের জীবনের মহিমা স্মরন করেই কবি লিখেছেন-
’এমন জীবন হবে করিতে গঠন
মরণে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন।’

চরিত্রবান ব্যক্তি ধনসম্পদে, জ্ঞান-বিজ্ঞানে ও বংশ মর্যাদায় কাঙাল হলেও গৌরবে মহান। এ জন্যেই সুভাষিত উক্তিতে বলা হয়েছে:
‘রাজার প্রতাপ অর্থ-সম্পদে কিন্তু চরিত্রবানের প্রতাপ হৃদয়ে।’

উপসংহার : পরিভোগপ্রবণ বিশ্বে আজ চারপাশে বাড়ছে মূল্যবোধের অবক্ষয়। চরিত্রের শক্তি হারিয়ে ফেলতে বসেছে মানুষ। ক্রমেই ডুবে যাচ্ছে অনৈতিক জীবনের অন্ধকারের অতলে। এ অবস্থায় জাতীয় জীবনে চাই চরিত্রশক্তির নবজাগরণ। যে প্রজন্ম চরিত্র হারিয়েছে তার কাছে কিছু আশা করার নেই। কিন্তু নতুন প্রজন্মকে বেড়ে উঠতে হবে চরিত্রের মহান শক্তি অর্জন করে। তা হলেই আমাদের ভবিষ্যৎ হবে সুন্দর।

↬ কর্ম  ও জীমনমূখী শিক্ষা 
↬ আত্মকর্মসংস্থানমূখী শিক্ষা 
↬ উৎপাদনমুখী শিক্ষা 
↬ জনসংখ্যার অভিশাপকে আশির্বাদে রূপান্তর
↬ কারিগরি শিক্ষা

ভূমিকা : শিক্ষা মানুষের সুপ্ত সম্ভাবনার বিকাশ ঘটায়। জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রে তাকে সামর্থ্য ও দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করে। বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কার ও সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক অগ্রগতির ফলে মানব জীবনের নিত্যনতুন কর্মদিগন্ত খুলে গেছে। ফলে বংশানুক্রমিক পেশাগত বৃত্তি অবলম্বন করে নিশ্চিত জীবনযাপনের দিন ফুরিয়ে গেছে। বরং নিত্যনতুন যে কর্মদিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে তার সঙ্গে বিশেষায়িত শিক্ষার যোগ হয়ে পড়েছে অপরিহার্য। এই কারণে আধুনিক বিশ্বে সাধারণ শিক্ষার চেয়ে কর্মমুখী শিক্ষা ক্রমের অধিকতর গুরুত্ব লাভ করছে।

সংজ্ঞা ও গুরুত্ব : কর্মমুখী শিক্ষা হচ্ছে জীবিকা অর্জনের জন্যে সম্ভাব্য পেশাগত কর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত শিক্ষা। মানুষের জীবনযাত্রার ধরন ও বৈশিষ্ট্যের ব্যাপক পরিবর্তন এবং জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতার ফলে কর্মমূখী শিক্ষার গুরুত্ব ও চাহিদা বাড়ছে। এককালে অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে বাস করে বাংলাদেশের মানুষ সুখে জীবন কাটিয়েছে। বৃত্তি বা পেশাগত শিক্ষা নিয়ে তাকে ভাবতে হয় নি। বংশানুক্রমিক পেশা অবলম্বন করেই জীবিকা নির্বাহ করেছে। কিন্তু এখন সে দিন আর নেই। জনসংখ্যা এখন বেড়েছে বিপুলভাবে। তার প্রচন্ড চাপ পড়েছে সীমিত সম্পদের ওপর। ফলে বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি অগ্রগতিকে কাজে লাগিয়ে আমাদের দেশে নব নব কর্মসংস্থান ও অগ্রগতির পথে অগ্রসর না হলে জাতীয় জীবনে নেমে আসবে অনিবার্য সংকট।
আর তার জন্যে দরকার নিত্যনতুন কর্ম, বৃত্তি ও পেশার সঙ্গে জড়িত কর্মমুখী শিক্ষা। কিন্তু দুঃখের বিষয় দেশে এখনও সেই ইংরেজ আমলে প্রবর্তিত প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতিতে কেরানি তৈরির উপযোগী সাধারণ শিক্ষার প্রাধান্যই রয়ে গেছে। ফলে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ডিঙিয়ে যারা বের হচ্ছে কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত না হওয়ায় তাদের ব্যাপক অংশেই বেকারত্বের অভিশাপ বয়ে বেড়াচ্ছে এবং প্রচন্ড হতাশায় জীবনের ওপর আস্থা হারাচ্ছে। এই কারণে যতই দিন যাচ্ছে কর্মমুখী বা বৃত্তিমূলক শিক্ষার গুরুত্ব সবাই উপলব্ধি করছে। বিশ শতকের শেষ দশকে আমাদের দেশে কর্মমুখী শিক্ষার গুরুত্ব বিশেষভাবে উপলব্ধি করা গেছে। এটা এখন স্পষ্ট যে, বর্তমান বাস্তবতায় কর্মমুখী বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। তা দেশের অগ্রগতি সাধনে যেমন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে তেমনি দেশে এবং দেশের বাইরে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে বেকারত্ব মোচনেও ফলপ্রসূ অবদান রাখতে সক্ষম। এতে বহু পরিবার অশান্তির হাত থেকে বাঁচতে পারে। এই শিক্ষার প্রসার ঘটলে সাধারণ ও উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে অনভিপ্রেত ভিড় হ্রাস পাবে। তাছাড়া কর্মমুখী শিক্ষা স্বকর্ম সংস্থানের নানা সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে এবং তা ফলত দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় ও দারিদ্র্য দূরীকরণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। কর্মমুখী শিক্ষা কেবল নতুন নতুন কর্মস্থানের সুযোগ তৈরি করে না, কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের নানা ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রেখে দেশের উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পারে। সেদিক থেকে কর্মমুখী শিক্ষা জাতির অর্থনৈতিক বুনিয়াদ রচনায়ও ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করতে পারে। কর্মমুখী শিক্ষা স্বাধীন পেশা গ্রহণে ব্যক্তির আস্থা গড়ে তোলে, তাকে স্বাবলম্বী করে তোলে এবং এভাবে বিপুল সংখ্যক বেকারত্বের হাত থেকে জাতিকে বাঁচায় এবং পরমুখাপেক্ষী অবস্থায় অভিশাপ থেকে রক্ষা করে। বিজ্ঞানের বিস্ময়কর উন্নতির যুগে কর্মমুখী শিক্ষা তাই আমাদের দেশের মতো উন্নয়নশীল দেশেও অনিবার্যভাবে প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে।

কর্মমুখী শিক্ষার স্বরূপ : কর্মমুখী শিক্ষা যান্ত্রিক শিক্ষা নয়। জীবনমুখী শিক্ষার পরিমন্ডলেই তার অবস্থান। পরিপূর্ণ ও সামগ্রিক জীবনবোধের আলোয় বিচার করা হয় কর্মমুখী শিক্ষার ভূমিকাকে। কর্মমুখী শিক্ষা নিঃসন্দেহে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক জনশক্তি সৃষ্টি করতে চায় কিন্তু তার মানবিক গুণাবলির বিকাশের দিকটিও উপেক্ষিত থাকতে পারে না। এদিক থেকে কর্মমুখী শিক্ষার লক্ষ ত্রিমুখী:

ক. জ্ঞান জিজ্ঞাসা সৃষ্টিতে : জ্ঞান-বিজ্ঞানের অর্জনের সঙ্গে শিক্ষার্থীর পরিচয় ঘটানো, অজানাকে জানার আগ্রহ সৃষ্টি এবং সুপ্ত গুণাবলির বিকাশ ঘটানো।

খ. মূল্যবোধ সৃষ্টি : শিক্ষার্থীকে নৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় এবং মানবিক-সাংস্কৃতিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত করা এবং গণতন্ত্রমনা, যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক নাগরিক হিসেবে তাকে গড়ে তোলা।

গ. কাজে উৎসাহ সৃষ্টি : কর্মমুখী, জীবনসম্পৃক্ত, বৃত্তিমূলক, উপার্জন মনষ্ক জনশক্তি গড়ে তোলা।

এই গুরুত্বপূর্ণ তিনটি লক্ষ অর্জন করতে পারলে বাড়তি জনশক্তি হবে জনসম্পদ আর তা না হলে, আংশিক কর্মমুখী শিক্ষা মানুষকে তৈরি করবে মানবিক মূল্যবোধ বিসর্জিত নিছক যন্ত্রে।

কর্মমুখী শিক্ষার বিদ্যমান সুযোগ : আমাদের দেশে এখনও কর্মমুখী শিক্ষার ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটে নি। ফলে প্রচলিত পন্থায় কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়ে লাখ লাখ উচ্চ শিক্ষিত যুবক-যুবতী বেকারত্বের চরম অভিশাপ নিয়ে দুশ্চিন্তা ও হতাশায় নিমর্জিত। অথচ উন্নত দেশগুলোর শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই কারিগরি, বৃত্তিমূলক ও পেশাভিক্তিক শিক্ষায় শিক্ষিত। এমনকি এশিয়ার দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুর, থাই্যোন্ড, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা ইত্যাদি দ্রুত উন্নয়নশীল দেশে কর্মমুখী শিক্ষা যথেষ্ট গরুদুত্ব পেয়েছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর ৫ শতাংশ কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত। আর বাংলাদেশে এ হার ১ শতাংশেরও কম। এর কারণ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় কর্মমুখী শিক্ষার প্রতি অনভিপ্রেত উপেক্ষা। এমনকি সাম্প্রতিককালে নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, অনেক কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে উন্নীতকরণের যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তাতেও কর্মমুখী শিক্ষার দিকটি যথেষ্ট উপেক্ষিত হয়েছে। এর ফলে অনিবার্যভাবে শিক্ষিত বেকারের সংক্যা আও বাড়ছে। অথচ যদি বৃত্তিমূলক শিক্ষার ক্ষেত্র সম্প্রসারণ করা হতো তবে অনেক তরুণ জীবন-জীবিকার নিশ্চিত অবলম্বনকে আশ্রয় করে সুখ-শান্তিময় ভবিষ্যৎ রচনা করতে সক্ষম হতো।

কর্মমুখী শিক্ষা প্রসারের প্রচেষ্টা : বাংলাদেশে কর্মমুখী শিক্ষার ক্ষেত্র যে একেবারে উন্নয়ন হয় নি তা নয়। বৃত্তিমূলক কারিগরি শিক্ষার কার্যক্রম ক্রমেই সম্প্রসারিত হচ্ছে। দেশে বিভাগ ও জেলা ভেদে প্রকৌশল, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। ২২টি মেডিকেল কলেজ ও ১টি ডেন্টাল কলেজের মাধ্যমে চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষা সম্প্রসারিত হয়েছে। এছাড়াও ৪টি প্রকৌশল ইনস্টিটিউট, অনেকগুলো পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ও ভেকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, লেদার টেকনোলজি কলেজ, টেক্সটাইল টেকনোলজি কলেজ, গ্রাফিক আর্ট ইনস্টিটিউট ইত্যাদির মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত ছোটখাটো কারিগরি প্রতিষ্ঠান দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ও হচ্ছে। তবে সব মিলিয়ে বৃত্তিমূলক শিক্ষার যে সুযোগ এখন বিদ্যমান তা যে বিপুল জনসংখ্যার তুলায় একেবারে নগণ্য তা বলাই বহুল্য।
তবে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার ঘটানোর জন্য সাম্প্রতিককালে সরকার মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরেই কর্মমুখী শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করে এই কার্যক্রমকে বেগবান করার উদ্যোগ নিয়েছেন। কারণ, মাধ্যমিক শিক্ষার ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে দেশের শিক্ষিত জনশক্তি। ইতমধ্যে মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরে কর্মমুখী শিক্ষা প্রসারে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সেগুলো হলো : কৃষিবিজ্ঞান ও গার্হস্থ্য বিজ্ঞানকে বাধ্যতামূলক করণ, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ডাবল শিফট চালু, স্কুল ও মাদ্রাসায় নবম ও দশম শ্রেণিতে বেসিক ট্রেড কোর্স চালু, ১৯৯৫ সাল থেকে সাধারণ শিক্ষা ও ভোকেশনাল শিক্ষা সমন্বয়ে এস. এস. সি. শিক্ষাব্যস্থা চালু, মাধ্যমিক স্তরে ব্যবসা ব্যবস্থাপনা শিক্ষাব্যবস্থা চালু ইত্যাদি।

কর্মমুখী শিক্ষাক্রম বাস্তমায়নের সমস্যা ও সুপারিশ : কর্মমুখী শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনাও অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। প্রয়োজনীয় শিক্ষক, অন্যান্য লোকবল, শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ, আর্থিক ব্যয় সংকুলানের ব্যবস্থা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও প্রকট সমস্যা বিধ্যমান। শিক্ষকদের গুণগত মান উন্নয়নের জন্যে প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তাও অনস্বীকার্য। এসব সমস্যা মোকাবেলার জন্যে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা প্রয়োজন:

১. কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু ও প্রসার করার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক ও মানসম্পন্ন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিত করা।

২. বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার জন্যে শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ করার জন্যে প্রয়োজনীয় ব্যয় বরাদ্দ।

৩. কর্মমুখী শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য শিক্ষকদের ভোকেশনাল শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন এবং

৪. বৃত্তিমূলক শিক্ষা, কারিগরি এবং কম্পিউটার বিজ্ঞান শিক্ষা কার্যক্রমে উৎসাহ তৈরির জন্যে জাতীয় প্রচার মাধ্যমে সৃজনশীল কার্যক্রম প্রচার।

উপসংহার: আমাদের দেশ বাড়তে থাকা বেকার সমস্যাসহ সামাজিক কুসংস্কার, জনসংখ্যা সমস্যা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস ইত্যাদি সমস্যায় জর্জরিত। এই প্রকট সমস্যা কাটিয়ে ওঠার অন্যতম প্রচেষ্টা হিসেবে তরুন সমাজকে উপযুক্ত গঠনমূলক ও কর্মমুখী শিক্ষা প্রদান অত্যন্ত কার্যকরী হবে। এ কাজে ব্যাপক উৎসাহ সৃষ্টি এবং তা বাস্তমায়নের জন্যে দরকার উপযুক্ত বাস্তব ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা এবং প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল। তাহলেই এ মহৎ প্রয়াস জাতীয় জীবনে ইতবাচক ফল বয়ে আনতে সক্ষম হবে।


[ একই রচনা আরেকটি বই থেকে সংগ্রহ করে দেয়া হলো: ]


ভূমিকা : বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব অসীম। সাধারণভাবে আমাদের দেশে শুধু সাধারণ শিক্ষায় ছাত্র-ছাত্রীরা পাস করে যাচ্ছে ফলে বেকারত্বের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত হলে সরকারি চাকুরী না হলেও তারা বেকার থাকবে না। শিক্ষা সমাপ্তির পর তারা নির্দিষ্ট কাজে লেগে জাতি গঠনে এগিয়ে আসতে সাহায্য করবে।

শিক্ষার প্রকারভেদ : সাধারণ অর্থে শিক্ষা দু’প্রকার-
(ক) সাধারণ শিক্ষা
(খ) কারিগরি শিক্ষা।

কারিগরি শিক্ষা কি? : কর্মমুখী শিক্ষা বা কারিগরি শিক্ষা বলতে আমরা সেই শিক্ষাকে বুঝি যা ব্যক্তিকে সংশ্লিষ্ট বৃত্তিমুখী করে তোলে। অর্থাৎ কারিগরি শিক্ষা একজন শিক্ষর্থীকে বাস্তব জীবনক্ষেত্রে একটি বিশেষ পেশার উপযোগী করে তার জীবিকা অর্জনে সহায়তা করে। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ সম্পদ লাভ করে, শিক্ষা মানুষের চিত্তের মুক্তি ঘটায়। জীবনের জন্য উভয়ই প্রয়োজন। কারিগরি শিক্ষা এ প্রয়োজন মেটাতে গভীরভাবে সাহায্য করে।

কারিগরি শিক্ষার বিভিন্ন স্তর : ইঞ্জিনিয়ারিং ও বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক বিষয়ে জ্ঞান লাভ ও যন্ত্রপাতির ব্যবহার এবং নির্মাণের বিদ্যা, ক্ষুদ্র যন্ত্রগুলোর উৎপাদন ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষা বলতে আমরা কারিগরি শিক্ষা বুঝিয়ে থাকি। একদিক থেকে চিকিৎসা বিজ্ঞানও বর্তমান যুগে কিছুটা বৈজ্ঞানিক কারিগরি শিক্ষার মধ্যে পড়ে। কারণ এখানেও যন্ত্রপাতির প্রচলন রয়েছে। শিক্ষাকে জীবনমুখী করার লক্ষ্যে জাতীয় শিক্ষাক্রমে যথেষ্ট পরিমার্জনা করা হচ্ছে। দেশে প্রকৌশল বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করছে। দেশে অনেক চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আছে অনেকগুলো পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট ও ভোকেশনাল ট্রেনিং ইন্সটিটিউট। এছাড়া লেদার টেকনোলজি, টেক্সটাইল ইন্সটিটিউট, গ্রাফিক আর্টস ইন্সটিটিউট এবং এ ধরনের আরও অনেক ট্রেনিং ইন্সটিটিউট।

বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষার আবশ্যিক বিষয়সমূহ : আমাদের মত এমন দরিদ্র দেশে বড় বড় শিল্প-কারখানা ব্যাপকভাবে গড়ে তোলার সুযোগ নেই। তাই এখানে ক্ষুদ্র ও কটির শিল্প প্রতিষ্ঠা করে দেশের বিপুল জনসংখ্যাকে কাজের উপযোগী করে গড়ে তোলা যায়। উচ্চ শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত দরিদ্র ও মেধাহীনদের কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন হাতের কাজ শেখানো যেতে পারে। পাটের ব্যাগ তৈরি, নানা রকম কাগজের ফুল তৈরি, হস্ত ও মৃৎজাত শিল্প, চামড়া, স্ক্রীন প্রিন্ট, বাটিক, ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের কাজ, টিভি, রেডিও, ভিসিপি, ভিসিআর, ফ্রিজ, এয়ারকন্ডিশনিং, বই বাঁধাই, অফসেট মুদ্রণ, কম্পিউটার ইত্যাদি শিখে আজকাল বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন যাপন করা যায়। এছাড়া কাঠমিস্ত্রী, রাজমিস্ত্রী, ইলেকট্রিক মিস্ত্রী, সেনিটারী ফিটিংস, ড্রাইভিং, হোটেল ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদিও বৃত্তিমূলক শিক্ষা হিসেবে গ্রহণ করলে সাধারণ চাকরিজীবীর চেয়ে অনেক ভালভাবে জীবন-যাপন করা যায়।

কারিগরি শিক্ষার কার্যকারিতা : সাধারণ শিক্ষা গ্রহণ করে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাই বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবার লব্ধ শিক্ষাকে কাজে না লাগিয়ে অন্য কোন পেশা অবলম্বন করে শিক্ষাকে অর্থহীন প্রমাণ করা হচ্ছে। তাই সাধারণ শিক্ষার প্রতি আগ্রহ কমিয়ে কারিগরি শিক্ষার প্রতি অনুরাগ দেখাতে হবে। দেশে বিভিন্ন পেশার মধ্যে মূল্য ও মর্যাদার যথেষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান থাকায় শিক্ষিত লোকের দৃষ্টি থাকে উচ্চ মর্যাদার দিকে। তদুপরি বর্তমান বিজ্ঞানের যুগে কারিগরি শিক্ষা ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নতি সম্ভব নয়। যন্ত্র বিজ্ঞানের এ প্রসারের যুগে আমাদের দেশেও কারিগরি শিক্ষার ব্যাপক প্রবর্তন করা উচিত।

শিল্পোন্নয়ন : অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য প্রয়োজন দ্রুত শিল্পায়ন। প্রকৃত শিল্পায়নের জন্য আবার প্রয়োজন কারিগরি শিক্ষা। কারিগরি জ্ঞান না থাকলে কল-কারখানা পরিচালনার কোন যোগ্যতাই জন্মাতে পারে না। তাই সর্বাগ্রে দেশের যুবক যুবতীদের বেশি সংখ্যায় কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে।

প্রয়োজনীয়তা : পুঁথিগত বিদ্যা বাস্তব জীবনে কর্মক্ষেত্রের অনুপযোগী, যে কারণে জাতিগতভাবে আমরা অগ্রসর হতে পারিনি। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ যদি জনশক্তিতে রূপান্তরিত না হয় তাহলে জাতির অগ্রগতি হয় না। জাতীয় জীবনে সমৃদ্ধি আসে না। তাই বর্তমানে বিশেষভাবে প্রয়োজন কারিগরি শিক্ষার।

উপসংহার : আমাদের দেশের অর্থনৈতিক সংকটের মূলে রয়েছে বিপুল জনগোষ্ঠী। এ অবস্থায় এ বিপুল জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করতে পারলে সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। কারিগরি শিক্ষার ব্যাপক সম্প্রসারণ করে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা যায় এবং তা বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন করা যায়। সর্বোপরি কারিগরি শিক্ষা জাতিকে দিতে পারে আত্মকর্মসংস্থানের উপায়।

ভূমিকা : যে-সব গুণ মানব-চরিত্রকে মহিমান্বিত করে তোলে ‘সত্যবাদিতা’ তার মধ্যে একটি মূল্যবান গুণ। সত্যের চেয়ে বড় গুণ আর দ্বিতীয়টি নেই। এই মহাবিশ্ব চির সত্যের ওপর দ-ায়মান। সত্য ও বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে মানুষ তার নিজেকে আবিষ্কার করে, মনুষ্যত্বকে অর্জন করে। তাই মানুষের সাধনা সত্যের সাধনা। সত্যবাদিতার গুণ অর্জন করাই মানুষের নিরন্তর সাধনা হওয়া উচিত। কোন কিছু গোপন না করে অকপটভাবে প্রকাশ করার বৈশিষ্ট্যের নামই সত্যবাদিতা।

বৈশিষ্ট্য : সত্য বলতে কোনো কিছুর যথাযথ প্রকাশ বোঝায়। আর সত্যবাদিতা অর্থ আরও ব্যাপক। শুধু ‘মিথ্যা না বলা’ বোঝাতে সত্যবাদিতা বোঝায় না। সত্যকে অবলম্বন করে যে বৈশিষ্ট্য বিকাশিত হয় তার নাম সত্যবাদিতা। সত্যের মধ্যে কোনো গোপনীয়তা নেই। সত্য জীবনের স্বরূপ বিকশিত করে। সত্যবাদী লোকের কথা ও কাজে কোনো পার্থক্য থাকে না। সত্যবাদিতা মানুষকে খাঁটি সোনার মতো নিখাদ করে তোলে। সত্যের মধ্যে মহান আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হয়। সত্যের মধ্য দিয়েই মানুষ অর্জন করে সততা। সততা মানব চরিত্রের অপার একটি মহৎ গুণ। কোনো প্রকার পাপের কাজ থেকে দূরে থেকে ন্যায় ও সত্যের প্রতিফলন ঘটিয়ে চরিত্রের বিকাশ ঘটাতে পারলে তাতে সততার যথার্থ পরিচয় পাওয়া যায়। তাই যুগে যুগে সত্যের সাধনা চলছে। প্রসঙ্গত কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন-
‘এত সব যার প্রাণ উৎসব সেই আজ শুধু নাই,
সত্য-প্রাণ সে রহিল অমর, মায়া যাহা হল ছাই!
ভুল যাহা ছিল ভেঙে গেল মহাশূন্যে মিলালো ফাঁকা,
সৃজন-দিনের সত্য যে, সে-ই রয়ে গেল চির আঁকা।’



শ্রেষ্ঠ গুণ : সত্যবাদিতা মানবজীবনের একটি শ্রেষ্ঠ গুণ। যে-সব গুণ জীবনকে সার্থক ও বিশিষ্ট করে তোলে তার মধ্যে সত্যবাদিতার স্থান সবার ওপরে। সত্যের অনুসারণে জীবন সুন্দর হয়। সত্যকে অবলম্বন করলে জীবনে সাফল্য অনিবার্য। সত্যবাদী লোক সমাজে সম্মান ও মর্যাদার আসন পান। সবাই তাঁকে বিশ্বাস করে। সকল পাপের উৎস হল মিথ্যা। কেননা মিথ্যা থেকেই শুরু হয় প্রতারণা, জালিয়াতি, শঠতাসহ নানাবিধ কুকর্ম। তাই মিথ্যা বলা মহাপাপ। আর সত্যবাদিতা মানুষের শ্রেষ্ঠ গুণ।

সত্যবাদিতার সুফল ও প্রয়োজনীয়তা : সত্যবাদীকে সবাই বিশ্বাস করে। সমাজে তাঁকে সবাই শ্রদ্ধার চোখে দেখে এবং ভালোবাসে। অপরদিকে মিথ্যাবাদীকে কেউ বিশ্বাস করে না। সমাজে তাকে সবাই ঘৃণার চোখে দেখে। সমাজে সত্যের জয় এবং মিথ্যার পরাজয় নিশ্চিত। সত্যবাদিতা থেকে বিচ্যুত হলে মানুষের নৈতিক অবক্ষয় ঘটে ফলে সমাজ জীবনে অবৈধ কার্যকলাপ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে এবং মানুষের মহৎ গুণাবলির তিরোধান ঘটে। মানুষ তখন নানা অন্যায় কাজে লিপ্ত হয়। সমাজে দেখা দেয় বিশৃঙ্খলা। তাই আদর্শ জীবনযাপনের জন্য সততা ও সত্যবাদিতা অপরিহার্য।

বাস্তব অবস্থা : সততা ও সত্যবাদিতা বাস্তব জীবনের একটি মহত্তর দিক হলেও বাস্তব জীবনে বিশেষত দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে তা যথার্থ মর্যাদা লাভ করতে পারছে না। সততা পরিহার করে মানুষ সত্যপথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে। ফলে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধিকেই তারা প্রাধান্য দিয়ে নানা রকমের অত্যাচার, অনাচার ও দুর্নীতি করে চলেছে। অসততার প্রতি মানুষে তেমন প্রতিবাদ বা বিরূপতা দেখা যাচ্ছে না। সততা বিসর্জন দিয়ে মানুষ এখন নিজের স্বার্থ সাধনে তৎপর। অন্যায় বা অবৈধ পথ অনুসরণ করায় এখন সমাজে এসছে অবক্ষয়। ঘরে-বাইরে সর্বত্রই আজ মনুষ্যত্বের দীনতার চিত্র। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় বড়দের কাছ থেকে ভালো কিছু শেখার আশা করা যায় না। যুব সমাজকে নতুন চেতনায় উদ্দীপ্ত করার মতো আজ কোনো পরিকল্পনা নেই, ফলে তারা প্রতিনিয়ত অবক্ষয়ের দিকে অগ্রসরমান। বস্তুত সমাজের সর্বস্তরে আজ যে সততা, সত্যবাদিতা ও মূল্যবোধের অভাব, তার মারাত্মক প্রতিক্রিয়া যবকদের মাঝে প্রতিনিয়ত বিস্তৃত হচ্ছে।

কর্তব্য : জীবনকে অবশ্যই সত্যবাদিতার মাধুর্যে ম-িত করতে হবে। অন্যায়ের বা অবৈধ উপায়ে যতই বিত্তশালী হোক না কেন তা যে পাপ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অসত্যের পরাজয় আসবেই ও ন্যায়ের পথ চির উজ্জ্বল থাকবেই। সেজন্য সততা ও সত্যবাদিতার অনুশীলন করতে হবে এবং জীবনে তার প্রতিফলন ঘটিয়ে যথার্থ মনুষ্যত্বের অধিকারী হতে হবে।

প্রভাব : মহামানবগণ সত্যের অনুসরণে তাঁদের জীবনের মহান সাধনাকে সফল করেছেন। সত্যবাদিতার জন্য যেমন তাঁরা লক্ষ্য অর্জনে সাফল্যলাভ করেছেন, তেমনি সত্যের বলে বলীয়ান হয়ে তাঁরা প্রবল শত্রুকেও পরাজিত করে নিজেদের প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করেছেন। সত্যের সাধনায় মহাপুরুষগণ জীবনকে যেভাবে গৌরবান্বিত করে গেছেন তা মানুষের কাছে মহান আদর্শ হিসেবে যুগ যুগ ধরে প্রেরণা দেয়।

উপসংহার : সত্যকে যারা মর্যাদা দেয় না তারা উদার হতে পারে না, তাদের মনে চিরদিন ভয় বিরাজ করে। সত্যবাদিতার মহৎ গুণের অভাবে মানুষের মন সব সময়ের জন্য ছোট হয়ে থাকে। অন্যাদিকে সত্যবাদী মানুষ নির্ভীক হয়, দুর্বার সাহস তার মনে বাসা বাঁধে। সে জন্য সত্যের পথ দৃঢ়ভবে আঁকড়ে থাকতে হবে, আর মনে রাখতে হবে কবিগুরুর অমর বাণী:
মুক্ত করো ভয়, আপন মাঝে শক্তি ধরো,
নিজেরে করো জয়,
দুর্বলেরে রক্ষা করো দুর্জনেরে হানো,
নিজেরে দীন নিঃসহায় যেন কভু না জানো।
মুক্ত করো ভয়,
নিজের ‘পরে পরিতে ভয় না রাখে সংশয়।

↬ পরিবেশ সংরক্ষণে বনায়ন
↬ পরিবেশ উন্নয়নে বৃক্ষরোপন
↬ গাছ লাগাও, পরিবেশ বাঁচাও 
↬ বন সংরক্ষণ
↬ সামাজিক বনায়ন
↬ বৃক্ষরোপন ও বৃক্ষসম্পদ উন্নয়ন

ভূমিকা : প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষরোপণের ভূমিকা যেমন ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী, তেমনি সুষম অর্থনৈতিক উন্নয়নেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিবেশের ভারসাম্য ও সুষম জলবায়ুর প্রয়োজনে একটি দেশের মোট আয়তনের অন্তত ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা আবশ্যক। আমাদের দেশের অর্থনৈতিক ও বিভিন্ন প্রয়োজন মেটাতেও পর্যাপ্ত বৃক্ষ থাকা অতীব প্রয়োজন। বৃক্ষহীনতার কারণে পৃথিবীর নতুন নতুন অঞ্চল মরুময় হয়ে পড়ছে। বিশ্বব্যাংকের মতে, বনের ওপর নির্ভরশীল বিশ্বের প্রায় ৫০ মিলিয়ন মানব জীবন বিকল হতে পারে আগামী শতকের মাঝামাঝিতে। ৩.৫ বিলিয়ন কিউবিক মিটার কাঠ ব্যবহার করে প্রতি বছর ৮ হাজার বর্গহেক্টর বনভূমি ধ্বংস করছে পৃথিবীর মানুষ। বনভূমি ধ্বংস হওয়ার ফলে পৃথিবীর উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব-পশ্চিমের বহু বন্যপ্রাণী ও সামুদ্রিক প্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে। এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার বিস্তৃত এলাকার মরুময়তা রোধে ২০ হাজার হেক্টর ভূমিতে বনায়ন করা অত্যন্ত প্রয়োজন।

বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা : বৃক্ষ মানব জীবনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। আমাদের জীবন ও জীবিকার জন্য বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। বৃক্ষ সমগ্র প্রাণীকুলের খাদ্যের যোগান দেয় এবং সুবিশাল শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে ছায়াদান করে উত্তপ্ত ধরণীকে সুশীতল রাখে। প্রাণীজগৎকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বৃক্ষ অক্সিজেন সরবরাহ করে এবং বাতাস থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে। আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী যেমন আসবাবপত্র, জ্বালানি কাঠ, গৃহনির্মাণ, রেল লাইনের স্লিপার, নৌকা, লঞ্চ, বাঁধ ইত্যাদি নির্মাণ করতে যে বিপুল পরিমাণ কাঠের প্রয়োজন হয় তা বৃক্ষ থেকে আসে। বিভিন্ন শিল্পদ্রব্যের কাঁচামাল যেমন রেয়ন, পেন্সিল, কাগজের মণ্ড, দেশলাইয়ের কাঠি ও বাক্স, কর্পূর, রাবার ইত্যাদি বৃক্ষ থেকে আসে। বনভূমি জীবনরক্ষাকারী ভেষজ ওষুধ তৈরির মূল্যবান উপাদান সরবরাহ করে। বন্যা, খরা ও ঝড় নিয়ন্ত্রণ করে বৃক্ষ প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে। ফলে আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ থাকে। এবং মাটির ক্ষয়রোধ করে মাটিকে উর্বর রাখে। বৃক্ষ গ্রীন হাউজ প্রতিক্রিয়া রোধ করে।


বাংলাদেশে বৃক্ষের অবস্থা : বাংলাদেশে প্রয়োজনের তুলনায় বনভূমি অত্যন্ত কম। তদুপরি জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে বনভূমি কর্তনের মাত্রাও ক্রমে বেড়ে যাচ্ছে। প্রকৃতির ভারসাম্য ঠিক রাখার জন্য কোনো দেশের মোট ভূমির ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা উচিত। প্রাপ্ত তথ্য মতে ১৯৪৭ সালে দেশের আয়তনের ২৪ ভাগ বনভূমি ছিল। ১৯৮০-৮১ সালে তা কমে হয় ১৭.২২ ভাগ এবং বর্তমানে মাত্র ১৭.০৮ ভাগ বনভূমি রয়েছে। এ আশঙ্কাজনক ঘাটতির কারণে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বিবিধ প্রয়োজন মেটানো। এর মধ্যে কৃষি জমির সম্প্রসারণ, বসতবাড়ি স্থাপন, শিল্পে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার, গৃহনির্মাণ সামগ্রী ও আসবাবপত্রের ব্যবহার, রাস্তা, বাঁধসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ, জ্বালানি হিসেবে ব্যাপক ব্যবহার, নগায়ন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। উল্লিখিত কারণগুলোর মধ্যে জ্বালানি হিসেবে বনসম্পদের ব্যবহার ৯৫ শতাংশ দায় ভার বহন করে। এ ছাড়া নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস বৃক্ষের ব্যাপক ক্ষতি করে। অদূর ভবিষ্যতে সাধারণ প্রয়োজনে বৃক্ষ সংকট এক প্রকট সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।

ধ্বংসপ্রাপ্ত বনাঞ্চল এবং বৃক্ষরোপণ : বনভূমি দ্রুত ফুরিয়ে আসায় সারা বিশ্বের জনগণের সচেতনতার সাথে সাথে বাংলাদেশের সরকার ও সচেতন জনগণ বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে এগিয়ে এসেছে। বাংলাদেশের বৃক্ষহীনতায় নিচের দূষণগুলো ঘটছে:

ক. বায়ুদূষণ : বৃক্ষ পরিবেশ থেকে বিষাক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিয়ে অক্সিজেন ফিরিয়ে দেয়। ধোঁয়া ও বালি, ক্লোরোফ্লুরো কার্বন, ধাতব কণা, আয়নাইজিং বিকিরণ, আগাছানাশক, কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক, কার্বন ডাই-অক্সাইড, তেজস্ক্রিয় পদার্থ ইত্যাদি হলো বায়ুদূষণের উৎস। ঢাকা শহরে সিসা, কার্বনমনোক্সাইড, হাইড্রোকার্বন প্রভৃতি উপাদান বাতাসে বিষাক্ততা ছড়িয়ে দিয়েছে। এ কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস শরীরে ঢুকে রক্তের হিমোগ্লোবিনের সাথে মিশে অক্সিজেনের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। হাইড্রোকার্বন যকৃতের ক্যান্সার ঘটায়। বাতাসে বিদ্যমান বিভিন্ন ধূলিকণা শ্বাসকষ্ট ও এলার্জির কারণ। সালফার ডাই-অক্সাইড বিভিন্ন ধরনের শস্যের ক্ষতি করে। এসিড বৃষ্টির ফলে মাটিতে পানির PH হ্রাস পায় এবং উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও বিকাশে ব্যাঘাত ঘটায়। এ দূষণের হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে পর্যাপ্ত সংখ্যক সবুজ উদ্ভিদ রোপণ করতে হবে।

খ. গ্রিন হাউস ইফেক্ট : গ্রিন হাউস অর্থ হলো সবুজ ঘর। মূলত এটা একটা কাচের ঘর যার মধ্যে তাপ সংরক্ষণ করে সবুজ গাছপালা জন্মানো হয়। বিজ্ঞানীরা ধারণা করেছেন, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে তাপ অপরিবাহী গ্যাসের আবষ্টেনীর জন্য সূর্য থেকে প্রাপ্ত তাপ ধরে রাখার মতো গ্যাসীয় আবরণ সৃষ্টি হয়েছে। এ গ্রাসীয় আবরণ গ্রিন হাউসের কাচের মতো কাজ করে। এ তাপ ধারণ অবস্থা যখন নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করে তখন তা জীবকুলের জন্য বিপজ্জনক হয়ে পড়ে। কাচের দেয়াল ও ছাদবিশিষ্ট গ্রিন হাউসের ভেতরের উত্তাপ কাচের ভেতর দিয়ে বাইরে যেতে পারে না। গ্রিন হাউসের কাচ যেমন প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে, তেমনি কার্বন ডাই-অক্সাইড, সিএফসি, নাইট্রাস অক্সাইড, মিথেন ইত্যাদি গ্যাসে তাপ বিকিরণে প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠে। বিজ্ঞানীদের মতে, ২০৮০ সালে বিশ্বের তাপমাত্র ৫ ডিগ্রি বৃদ্ধি পাবে, আর্কটিক মহাদেশের বিশাল বরফস্তর ক্ষয়ে যাবে যার ফলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়বে। সমুদ্রে পানির উচ্চতা ১ মিটার বাড়লে পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ অর্থাৎ মালদ্বীপ, বাংলাদেশসহ বহু দেশ ১০ ফুট পানির নিচে তালিয়ে যাবে। গ্রিন হাউস ইফেক্ট থেকে রক্ষা পেতে বৃক্ষ কাটা রোধ ও বৃক্ষরোপণ করতে হবে। নতুবা এর পরিণাম হবে ভয়াবহ।

গ. ভূমিক্ষয় : বৃক্ষহীনতার কারণে অনবরত ভূমিক্ষয় বাড়ছে, নদীর ভাঙন বৃদ্ধি পেয়েছে। বনভূমি ধ্বংসের ফলে ভূমিক্ষয়ের প্রবণতা বাড়ে এবং খরা ও মরুকরণ ত্বরান্বিত হয়। ড. তারক মোহন দাসের মতে, একটা গাছ তার পঞ্চাস বছর জীবনকালে প্রায় দুই লাভ পঞ্চাস হাজার টাকার মূল্যের মাটির ক্ষয় উর্বরতা বৃদ্ধি করে। তাই ভূমিক্ষয় রোধে বৃক্ষরোপণ আশু প্রয়োজন।

ঘ. প্রাকৃতিক দুর্যোগ : বাংলাদেশে উপকূলীয় দুর্যোগ বৃদ্ধি পেয়েছে উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনীহীনতার কারণে। বাংলাদেশের সুন্দরবন ও বান্দরবান দুর্যোগের বিরুদ্ধে অতন্দ্র প্রহরী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

পরিবেশ দূষণ রোধে উদ্ভিদ : পরিবেশকে দূষণমুক্ত করতে উদ্ভিদ বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। প্রাণীজগৎ শ্বাস-প্রশ্বাস ও দহনকার্যের ফলে প্রচুর পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়মণ্ডলে যোগ করছ এবং সেখান থেকে প্রচুর পরিমাণ অক্সিজেন গ্রহণ করছে। প্রাণীজগৎ যেমন বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি করছে, অন্যদিকে অক্সিজেনের পরিমাণ হ্রাস করছে। সবুজ উদ্ভিদ বায়ুমণ্ডলের এ ভয়াবহতা দূর করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে। সবুজ উদ্ভিদ বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ হ্রাস করে পরিবেশকে দূষণমুক্ত করে। উদ্ভিদ মাটিকে দৃঢ়ভাবে আটকে রেখে মাটির ক্ষয়রোধ করে। গ্রীন হাউস ইফেক্ট থেকে রক্ষা পেতে হলে উদ্ভিদ রোপণ করতে হবে।

বনজসম্পদ উন্নয়ন : বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বনজসম্পদের গুরুত্ব অপরিসীম কিন্তু পরিতাপের বিষয়, বাংলাদেশে প্রয়োজনের তুলনায় বনভূমি খুবই কম। নির্বিচারে বৃক্ষকর্তনের ফলে আমাদের বনভূমি সংকুচিত হয়ে আসছে। আমাদের বনভূমি সংকুচিত হয়ে বর্তমানে মোট স্থলভাগের শতকরা ১৭.০৮ ভাগে এসে দাঁড়িয়েছে। আমাদের অর্থনীতির উন্নয়নের স্বার্থে বাংলাদেশের বনজসম্পদের উন্নয়ন ও সংরক্ষণ দরকার। নিম্নবর্ণিত উপায়ে বাংলাদেশের বনজসম্পদের উন্নয়ন করা যেতে পারে :

নতুন বনভূমি সৃষ্টি : বাংলাদেশের নদীতীর, উপত্যকা, পাহাড়ি উচ্চ অঞ্চল এবং সমুদ্র উপকূলে বনভূমি গড়ে তুললে বনাঞ্চল বৃদ্ধি পাবে।

নির্বিচারে বৃক্ষকর্তন রোধ : আমাদের বনজসম্পদের ওপর মানুষের বেপরোয়া হামলা চলছে। নির্বিচারে বৃক্ষকর্তন রোধ করে বিনষ্ট হয়ে যাওয়া বনকে পুনরায় সজীব করে তোলার সার্বিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

আবাদযোগ্য জমি সৃষ্টি রোধ : মানুষ আবাদযোগ্য জমি সৃষ্টি করতে নির্বিচ্চারে বৃক্ষকর্তন করে চলছে, বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে এটি রোধ করতে হবে।

জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি : বণাঞ্চলের অর্থনৈতিক ও প্রাকৃতিক গুরুত্ব সম্পর্কে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করে বিনামূল্যে বিভিন্ন জাতের চারাগাছ সরবরাহ করতে পারলে বনায়ন প্রক্রিয়া জোরদার হবে।

বনজসম্পদ উন্নয়নে সরকারি ব্যবস্থা : বাংলাদেশ সরকার দেশের বনজসম্পদের গুরুত্বের পরিপ্রেক্ষিতে এর উন্নয়ন ও সংরক্ষণের বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। বনজসম্পদের উন্নয়ন ও তার সুষ্ঠু ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশে বনশিল্প উন্নয়ন সংস্থা গঠন করা হয়েছে। তাছাড়া বন গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়েছে এবং বনবিষয়ক শিক্ষা প্রদানের জন্য সিলেটে একটি বন মহাবিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে বনজসম্পদের ওপর স্নাতন ডিগ্রি প্রদান করা শুরু করেছে।

বৃক্ষসম্পদ উন্নয়নে করণীয় : বৃক্ষসম্পদ বৃদ্ধিতে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে :

১. সামাজিক বনায়নের জন্য নতুন এলাকা বেছে নিতে হবে। যেমন নদীর ধার, পাহাড়ের ঢাল, উপকূল, রেল ও সড়কের পাশে অধিক হারে গাছ লাগাতে হবে।

২. বনভূমি থেকে কাঠ সংগ্রহের জন্য আর কোনো গাছ যেন না কাটা হয় সে ব্যবস্থা নিতে হবে। গাছ কাটা হলে পুনরায় নতুন চারা রোপণ করে শূন্যতা পূরণ করতে হবে।

৩. বনভূমির নতুন নতুন এলাকাকে অভয়ারণ্য হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। পার্শ্ববর্তী দেশে নতুন নতুন বন সৃষ্টি করে তা অভয়ারণ্য হিসেবে চিহ্নিত করে প্রাণীদের রক্ষায় যে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে আমাদের দেশেও সে ব্যবস্থা নিতে হবে।

৪. সরকারিভাবে বনায়নের যে উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে তা দূর করতে হবে। বনভূমি সংরক্ষণের জন্য এগিয়ে আসতে হবে।

উপসংহার : বৃক্ষরোপণ বা বৃক্ষসম্পদের উন্নয়ন আমাদের অস্তিত্বের জন্যই জরুরি। পাশাপাশি এটি অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক, কাজেই কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়। আমাদেরকে আন্তরিকভাবেই বনজসম্পদের উন্নয়নে উদ্যোগী হতে হবে। কেবল সরকারি বা এনজিও পর্যায়ে নয়, এ ব্যাপারে আমাদের পারিবারিক ও ব্যক্তিগতভাবেও উদ্যোগী হতে হবে।


[ একই রচনা আরেকটি বই থেকে সংগ্রহ করে দেয়া হলো: ]


ভূমিকা:
“বৃক্ষ নেই, প্রাণের অস্তিত্ব নেই, বৃক্ষহীন পৃথিবী যেন প্রাণহীন মহাশ্মশান।”

অফুরন্ত সৌন্দর্যের এক মধুর নিকুঞ্জ আমাদের এ পৃথিবী। এই পৃথিবীকে সবুজে-শ্যামলে ভরে দিয়েছে প্রাণপ্রদায়ী বৃরাজি। এ বিশ্বকে সুশীতল ও বাসযোগ্য করে রাখার ক্ষেত্রে বৃক্ষের অবদান অনস্বীকার্য। আবার মানুষের সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্যে যেসব মৌলিক চাহিদা রয়েছে তার অধিকাংশই পূরণ করে বৃক্ষ। তাই মানবজীবনে বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা অপরীসীম।
“দাও ফিরিয়ে সে অরণ্য, লও এ নগর”

-কবির এ আর্তি আজ অরণ্যে রোদনে পরিণত হয়েছে। কেননা অরণ্য দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে মানুষের কুঠারের আঘাতে। এ হচ্ছে মানুষের আত্মঘাতি কর্ম।

বাংলাদেশের বনাঞ্চল: প্রাকৃতিক লীলা বৈচিত্রের এ দেশে বনভূমি সৃষ্টি হয়েছে বিচিত্র রূপে। বাংলাদেশের বনাঞ্চলকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা:
১. ক্রান্তীয় চিরহরিৎ বনভূমি
২. শালবন বনভূমি ও
৩. স্রোতজ বনভূমি

চট্টগ্রাম, পার্বত্য জেলাসমূহ ও সিলেট অঞ্চলে পনের হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে রয়েছে ক্রান্তীয় চিরহরিৎ বনভূমি। ভাওয়াল ও মধুপুরের এক হাজার বর্গকিলোমিটার এবং ময়মনসিংহ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, রংপুর, দিনাজপুর, কুমিল্লার বিশাল এলাকা জুড়ে রয়েছে শালবন। আর দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সমুদ্র উপকূলবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বিরাজমান সুন্দরবন-ই হচ্ছে স্রোতজ বনভূমি।

বাংলাদেশের বনভূমির পরিমাণ: একটি দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্যে মোট ভূমির শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, আমাদের দেশে মোট ভূমির মাত্র ১৬ ভাগ বনভূমি রয়েছে যা দেশের প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। তবে এটি সরকারি হিসেবে, প্রকৃত-প্রস্তাবে বনভূমির পরিমাণ মাত্র ৯%, আর World Research Institute এর মতে মাত্র ৫%। দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বনভূমির পরিমাণ মাত্র ৩.৫%। তাই ইতমধ্যেই বাংলাদেশে প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। দেশে সময়মতো বৃষ্টিপাত হচ্ছে না এবং অসময়ে প্রচুর বৃষ্টিপাত, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি নেত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এভাবে নির্বিচারে বৃক্ষনিধনের ফলে শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বপরিবেশে দেখা দিয়েছে গ্রীনহাউজ প্রতিক্রিয়া।

বনায়ন বা বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা: World Research Institute এর মতে, বিশ্বের বনভূমি উজাড় হতে হতে অর্ধেকে এসে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে বিশ্ব পরিবেশ হুমকির মুখে পড়েছে। মানুষ ও প্রাণীর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বৃক্ষের ব্যাপক আবশ্যকতা রয়েছে। তাই বৃক্ষকে মানবজীবনের ছায়াস্বরূপ বলা হয়। বৃক্ষ আমাদের নীরব বন্ধু, সে আমাদেরকে প্রতিনিয়ত কত যে উপকার করছে তা একবার ভেবে দেখলে অনুধাবন করা যায়। প্রত্যক্ষ বা পরোভাবে বৃক্ষই আমাদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছে। নিচে বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তার কয়েকটি দিক উল্লেখ করা হল:
  • বৃক্ষ প্রাণীজগৎকে খাদ্য দেয়। মানুষ ও পশু-পাখি বৃক্ষের ফুল-ফল এবং লতা-পাতা খেয়ে জীবন ধারণ করে।
  • বৃক্ষ সকল প্রাণিকুলের ত্যাগ করা বিষাক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে আর দেয় জীবন রক্ষাকারী অক্সিজেন। ফলে প্রাণীরা এ জগতে বেঁচে থাকতে পারে।
  • আমরা তাপ উৎপাদন, রন্ধন এবং অন্যান্য জ্বালানি কাঠ বৃক্ষ হতে পেয়ে থাকি।
  • আসবাবপত্র, গৃহ, নৌকা, জাহাজ, বাঁধ, সেতু ইত্যাদি নির্মাণে বৃক্ষ আমাদের কাঠ দেয়।
  • বৃক্ষ থেকে কাগজের মন্ড এবং রেয়ন শিল্পের কাঁচামাল ও দিয়াশলাই তৈরি হয়।
  • বনভূমি থেকে মধু ও মোম সংগ্রহ করা হয়।
  • গাছপালা দেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ করে।
  • গাছপালা জমির উর্বরতা-শাক্তি বৃদ্ধি করে অধিক উৎপাদনে সাহায্য করে।
  • গাছপালা নদীর ভাঙন, বৃষ্টিপাত ও পানি-স্ফীতির হাত থেকে রক্ষা করে। এতে মাটিতে স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।
  • বৃক্ষাদি ঝড়-ঝঞ্ঝা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে বাসগৃহকে রাক্ষা করে।
  • বৃক্ষ আমাদের জীবন রক্ষার নানা ওষুধ দান করে।
বৃক্ষরোপণ অভিযান: বনজ সম্পদকে টিকিয়ে রাখা ও এর সম্প্রসারণের জন্যে আমাদের দেশে প্রতিবছর বৃক্ষরোপন অভিযান পরিচালনা করা হয়। সপ্তাহ, পক্ষকাল বা মাসব্যাপী এ অভিযান চলে। এ সময় পরিকল্পিত উপায়ে বৃক্ষরোপণ করা হয়। সাধারণত প্রতি বছর বর্ষাকালে সরকারের বনবিভাগের উদ্যোগে বৃক্ষরোপণ অভিযান চালানো হয়। এ সময় জনগণ নিকটস্থ নার্সারী থেকে বিনামূল্যে অথবা স্বল্প মূল্যে গাছের চারা সংগ্রহ করতে পারে। অভিযান চলাকালে আমাদের জীবনে বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা ও চারা রোপণের পদ্ধতি সম্পর্কে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে শিক্ষা দেয়া হয়। নিঃসন্দেহে বৃক্ষরোপণ অভিযান একটি মহৎ প্রচেষ্টা।

বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি ও গৃহীত পদপে: ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন করে আসছে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বন অধিদপ্তর কর্তৃক ১৯৮২ সালে উত্তরাঞ্চলের বৃহত্তর রাজশাহী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলায় গৃহীত ‘কমিউনিটি বনায়ন’ কর্মসূচি। ৭ হাজার গ্রামকে এই কর্মসূচির আওতায় আনা হয়। ১৯৮৭-৮৮ সালে দেশের ৬১ জেলায় ‘থানা বনায়ন ও নার্সারি উন্নয়ন প্রকল্প’ হাতে নেওয়া হয় এবং বনায়ন সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির জন্যে ৮০ হাজার ব্যক্তিকে বিভিন্ন মেয়াদে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় আর জনসাধারণের মধ্যে ৬ কোটি চারা বিতরণ করা হয়। উপকূলীয় চরাঞ্চলে, সব কটি মহাসড়কের দুপাশে, রেল সড়কের ধারে এবং বাঁধ এলাকায় এই বনায়নে ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেছে। ১৯৯৬ সালে উপকূলীয় দ্বীপাঞ্চলের ম্যনগ্রোভ গাছপালা লাগানো শুরু হওয়ার পর ইতোমধ্যে ১ লক্ষ ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে বনায়ন সম্পন্ন হয়েছে। সরকার বনায়ন বৃদ্ধিতে এখনো নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে যাচ্ছে।

বনায়নের উপায় : বাংলাদেশে বনায়নের সম্ভাবনা বিপুল। নানাভাবে এ বনায়ন সম্ভব। একটি পন্থা হলো : সামাজিক বন উন্নয়ন কর্মসূচি। এর লক্ষ্য হলো : রাস্তার পাশে বৃক্ষরোপণে জনসাধারণকে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করানো। জনগণ যাতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ কর্মসূচিতে যোগ দেয় সেজন্যে অর্থনৈতিক প্রণোদনা থাকতে হবে। তাছাড়া নানা জাতের বৃক্ষ মিশ্রণ করে রোপণ করতে হবে যেন গ্রামবাসীরা খাদ্য, ফল, জ্বালানী ইত্যাদি আহরণ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে আর একটি বিকল্প হচ্ছে, বনায়ন কর্মীদের অতিরিক্ত আয়ের উৎস প্রদান করা। এছাড়া সরাসরি ঋণ, ভর্তুকি এবং অনুদান প্রদান, বিনামূল্যে বীজ ও চারা সরবরাহ, বনায়ন-বৃক্ষায়ণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি, সার, খাদ্য ইত্যাদি সাহায্য, ফসল ভাগাভাগিকরণ ইত্যাদি ব্যবস্থা করা। ওয়ার্ড মেম্বারের নেতৃত্বে এবং শিক্ষক, সমাজকর্মী, মসজিদের ইমাম প্রমুখের সমন্বয়ে গঠিত গ্রাম সংস্থা এই বনায়নের প্রয়োজনীয়তা পূরণ করতে পারে। এ সংস্থা সরকারি-বেসরকারি দপ্তরের সাথে সামাজিক বনায়ন-বৃক্ষায়ণ সম্পর্কিত সকল বিষয় তদারক করবে এবং গ্রামের জনসাধারণকে পরিবার ভিত্তিতে বনায়নের কাজে সম্পৃক্ত করবে। যেমন- বাঁধ, সড়ক, রেলপথ, খালের পাড়, খাস পুকুর পাড়, খাস জমি ইত্যাদির আশেপাশে যেসব পরিবার বাস করে তারা নির্দিষ্ট পরিমাণ জায়গা বরাদ্দ পাবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী এবং সরকারি-বেসরকারি সহায়তার আওতায় তারা বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যার ভার গ্রহণ করবে এবং এ থেকে যে আয় হবে নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী সে আয়ের অংশ তারা পাবে। এভাবে যেসব পরিবার খালি জায়গা পাহাড়-পর্বতের আশেপাশে থাকে তাদেরকে সেখানে বনায়নে সম্পৃক্ত করা হবে।

বৃক্ষহীনতার অপকারিতা: বৃক্ষশূন্যতা যে কী ভয়াবহ তার জ্বলন্ত উদাহরণ আফ্রিকার অঞ্চল। বৃক্ষশূন্য, পানিশূন্য এলাকার মানুষ চলে গেছে অন্য এলাকায়। বাংলাদেশেও এর অশুভ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস তো লেগেই আছে। নির্বিচারে বৃক্ষনিধনের ফলে শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বপরিবেশে দেখা দিয়েছে গীনহাউজ প্রতিক্রিয়া। বিশ্বপরিবেশ আজ বিপর্যস্ত ও হুমকির সম্মুখীন। 

উপসংহার: অস্বীকার করার উপায় নেই যে, কেবল বৃক্ষরোপণ সপ্তাহ পালন করে সরকারিভাবে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে জনসেবা করলেই দেশ সবুজ হয়ে যাবে না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই এ কর্মসূচি পালন করে আসা হচ্ছে। অথচ বৃক্ষরোপণ অভিযান এখনো আশানুরূপ নয়। একে সফল করতে হলে দেশব্যাপী ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। এমনকি স্কুল-কলেজে পাঠ্য পুস্তকে এর গুরুত্ব নির্দেশ করে আরো অধিক হারে প্রবন্ধ রচনা করা প্রয়োজন।

উৎস:
১. বন, বনবিনাশ ও বনবাসীর জীবন সংগ্রাম, ফিলিপ গাইন, সেড, ঢাকা, বাংলাদেশ।
২. পরিবেশপত্র, ৫-১২তম সংখ্যা।
৩. গণ উন্নয়ন গ্রন্থাগার : পরিবেশ ও উন্নয়ন, বুলেটিন ৪২।

ভূমিকা: পৃথিবীর সর্বত্রই নিয়মের রাজত্ব। আকাশের চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রেই নিয়মের অবাধ গতি। পৃথিবী আপন কক্ষ পথে ঘুরছে, সূর্য পূর্বে উঠে পশ্চিমে অস্ত যায়। ষড়ঋতুপর্যায়ক্রমে ঘুরে আসে। রাতের পর দিন আসে। কোন কিছুই নিয়ম বহির্ভূত নয়। সৃষ্টির শুরু থেকে নিয়মের উৎপত্তি এবং সৃষ্টির শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এ নিয়ম চলতে থাকবে। শৃঙ্খলা প্রসঙ্গে Napoleon বলেছেন.....

“Discipline is the keystone to success which is compulsory to follow to balance the system.”


প্রাণিজগতে নিয়ম: প্রাণিজগতের সর্বত্র নিয়মের লীলাখেলা চলছে। নিয়ম না মানলে প্রাণিজগত হয়ে উঠে বিশৃঙ্খল। পাখিরা সকালে জেগে গান করে, দিন খাদ্যান্বেষণে ঘুরে বেড়ায়, রাতে বিশ্রাম করে, এদের সব কিছুই রুটিনমাফিক হয়ে থাকে। মৌমাছি, পিপীলিকা দল বেঁধে তাদের নেতার নির্দেশ মেনে চলে। মৌমাছি অপূর্ব মৌচাক রচনা করে সুশৃঙ্খলভাবে জীবনযাপন করে।

সমাজ জীবনে নিয়ম: নিয়মছাড়া সামাজিক জীবন চলতে পারে না। বিভিন্ন সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান যেমন- বিবাহ, ঈঁদ-পূজা, খাওয়া-পরা সবকিছুই নিয়ম অনুযায়ী হয়ে থাকে। নিয়ম না থাকলে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা থাকে না। সমাজে কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলা আছে বলেই আমরা আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব মিলে সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করতে পারি। মোট কথা, নিয়মানুবর্তিতা সমাজ জীবনকে সুন্দর করে তোলে। তাই কবির ভাষায়...
“যে সমাজে শৃঙ্খলা আছে, ঐক্যের বিধান আছে,
সকলের স্বতন্ত্র ও সধিকার আছে,
সেই সমাজেই পরকে আপন করিয়া লওয়া সহজ।”
--------------রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর



মানব জীবনে নিয়ম: মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। অন্যান্য প্রাণী থেকে তার পার্থক্য সে বুদ্ধিমান ও নিয়রেম পূজারী। নিয়মানুবর্তিতা বা শৃঙ্খলাবোধ না থালে মানব জীবনকে সুন্দর ও সার্থক করে তোলে। মানুষকে আহার-বিহর, শ্রম-বিশ্রম, চাল-চলন ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে নিয়ম মেনে চলতে হয়। যে ব্যক্তি যথানিয়মে নিজ কর্তব্য সম্পাদন করে, তার উন্নতি অবধারিত। মানব জীবনে শৃঙ্খলার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে M. K. Gandhi বলেছেন.......
“Discipline maintains system,
System maintain development,
Development vibrates human-life.
So discipline must be followed.”

ছাত্রজীবনে নিয়ম: ছাত্রজীবনে নিয়মানুবর্তিতার প্রয়োজন সর্বাধিক। নিয়মানুবর্তিতা শির ও অভ্যাসের উপযুক্ত সময় হচ্ছে ছাত্রজীবন। একজন ছাত্রকে নিয়মমাফিক পড়ালেখা করতে হয়, সময়মত পরীক্ষা দিতে হয়। এভাবে নিয়ম পালনে তাকে অভ্যস্ত হতে হয়। নিয়ম মানা ছাড়া ছাত্রজীবনে সার্থকতা অসম্ভব। অর্থাৎ...
Read while you read,
Play while you play,
That is the way,
To be happy and gay.

সৈনিক জীবনে নিয়ম: নিয়মানুবর্তিতার উপযুক্ত চর্চা হয় সৈনিক জীবনে। দলনেতার হুকুম পালন করা তাদের প্রধান কর্তব্য। সকালে ঘুম থেকে উঠা, প্যারেড করা, খাওয়া, ঘুমান সবকিছুই তাদের নিয়মমাফিক করতে হয়। নিয়মানুবর্তিতার প্রতি সৈনিক জীবনে জোর দেয়ার কারণ হচ্ছে একজনের সামান্য নিয়মভঙ্গের কারণে হাজার হাজার সৈন্যের জীবন বিনষ্ট হতে পারে। তাই নিয়মভঙ্গের কারণে তাদের কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়।
নিয়মানুবর্তিতার প্রয়োজনীয়তা: জীবনের সর্বস্তরে তথা সামাজিক, পারিবরিক, রাষ্ট্রীয় জীবনে, খেলার মাঠ, কল-কারখানায়, দোকানে, রেলে, হাসপাতালে, বিমানে প্রভৃতি ক্ষেত্রে নিয়মানুবর্তী হওয়া অত্যাবশ্যক। নিয়ম-শৃঙ্খলার অভাবে অনেক সুপ্রতিষ্ঠানও ধ্বংস হয়ে যায়। খেলার মাঠে ও যুদ্ধের ময়দানে নিয়ম পালন না করলে পরাজয় অনিবার্য। সুতরাং নিয়মানুবর্তিতা বা শৃঙ্খলাবোধের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য।

নিয়মানুবর্তিতা ব্যক্তি স্বাধীনতার অন্তরায় নয়: অনেকের ধারণা, কঠোর নিয়মানুবর্তিতা ব্যক্তি স্বাধীনতার পরিপন্থী। কিন্তু এ ধারণা মোটেও সত্য নয় বরং নিয়ম মানার মাধ্যমে নিজের অধিকার রক্ষিত হয়। নিয়মানুবর্তিতা ব্যক্তির স্বাভাবিক বিকাশের পথকে সুগম করে। অন্যথায় অনিয়ম স্বেচ্ছাচারিতার বিকাশ ঘটায়। পরিণামে জীবন দুঃখময় হয়ে উঠে। তাই নিয়মানুবর্তিতাকে ব্যক্তি স্বাধীনতার পরিপন্থী বলার কোন যুক্তি নেই। মনে রাখা দরকার, স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতা এক জিনিষ নয়।

নিয়মানুবর্তিতা ভঙ্গের ফল বিপর্যয়: নিয়মভাঙ্গার ফলাফল সর্বদাই অশুভ। ব্যক্তিজীবনে, সমাজ জীবনে কিংবা জাতীয় জীবনে যেকোন নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটলে বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী। এ শুধু প্রকৃতিতে নয় মানব জীবনেও সত্য। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর নির্দেশ অমান্য করে মুসলিম বাহিনী ‘ওহুদের যুদ্ধে’ বিশৃঙ্খলভাবে শত্রুর উপর আক্রমণ চালাতে গিয়ে চরম বিপদের সম্মুখীন হয়েছিল। নিয়মানুবর্তিতার অভাবে প্রতিভাশালী মানুষের জীবনও ব্যর্থ হয়ে যায়। যার জ্বলন্ত উদাহরণ মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। মোটকথা, নিয়মানুবর্তিতার অভাব জীবনের গ্লানিই শুধু বাড়ায়।

উপসংহার: নিয়মানুবর্তিতা ছাড়া জীবন যুদ্ধে জয়ী হওয়া সম্ভব নয়। মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই নিয়মানুবর্তিতার গুরুত্ব অপরিসীম। নিয়ামানুবর্তিতার ব্যর্থতায় ঘটে আরাজকতা, বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পায়; মানুষকে পদে পদে বিপদের সম্মুখীন হতে হয়। পাশ্চাত্যের দেশসমূহের শক্তি, ধন, জ্ঞান ইত্যাদি মূলে রয়েছে তাদের কঠোর শৃঙ্খলাবোধ। তাই আমাদেরও জাতীয় উন্নতির জন্য নিয়মানুবর্তী হওয়া আবশ্যক। এক কথায়.....
নিয়মানুবর্তিতাই উন্নতির চাবিকাঠি।’

Author Name

Contact Form

Name

Email *

Message *

Powered by Blogger.