প্রবন্ধ রচনা’র রীতি-নীতি

প্রবন্ধ কী?
নাতিদীর্ঘ সুবিন্যস্ত গদ্য রচনাকে সাধারণত প্রবন্ধ বলা হয়ে থাকে। একে আমরা রচনা বলেও অভিহিত করে থাকি। 

যে কোনো বিষয়ে যে কোনো উদ্দেশ্যে যে কেউ প্রবন্ধ লিখতে পারেন- তা সে মতামত প্রকাশের জন্যে হোক, কিংবা কোনো কিছু জানানোর জন্যেই হোক। সেদিক থেকে প্রবন্ধ নানা রকম হতে পারে। ব্যক্তিগত জীবনের কোনো স্মরণীয় ঘটনার বর্ণনামূলক স্মৃতিচারণ থেকে শুরু করে বিশদ ব্যাখ্যামূলক কিংবা যুক্তি প্রধান গদ্য রচনা যেমন প্রবন্ধের পর্যায়ে পড়ে তেমনি কোনো বিশ্লেষণ বা মূল্যায়নধর্মী লেখা, কোনো বিষয়ে সমালোচনা কিংবা অনুসন্ধানমূলক রচনাও প্রবন্ধ বলে গণ্য হতে পারে। সাধারণত প্রবন্ধে কোনো-না-কোনো ভাবে বিষয়বস্তু সম্পর্কে লেখকের ব্যক্তিগত ভাব-ধারণা, চিন্তাধারা, অভিজ্ঞতা ইত্যাদির প্রতিফলন ঘটে। 

প্রবন্ধের শ্রেণিবিভাগ 
প্রবন্ধ প্রধানত দু রকম হতে পারে : ক. ভাবগম্ভীর, খ. লঘু। 

ভাবগম্ভীর প্রবন্ধে লেখকের বক্তব্য হয় অনুপুঙ্খ, চিন্তাগভীর, যক্তিপ্রধান এবং অত্যন্ত সুবিন্যস্ত। পক্ষাপন্তরে লঘু রচনা লেখা হয়ে থাকে অনেকটা হালকা বৈঠকি মেজাজে ও লঘু চালে। তা তত্ত্ব, তথ্য ইত্যাদি ভারাক্রান্ত গুরুগম্ভীর প্রবন্ধের মতো হয় না। যুক্তি-প্রমাণ, বিচার-বিশ্লেষণের চেয়ে এ ধরনের রচনায় থাকে বিষয়বস্তুর সহজ সরল, স্নিগ্ধ ও রম্য উপস্থাপনা। তাতে লেখকের ব্যক্তিগত আবেগ, অনুভূতি, অভিজ্ঞতা ও ব্যক্তিত্বের ছাপ পড়ে। 

প্রবন্ধে বর্ণনামূলক রচনারীতি 
বর্ণনা হচ্ছে এক ধরনের রচনা কৌশল, যে ক্ষেত্রে লেখন দৃষ্টি, রঙ, ধ্বনি, গন্ধ, স্বাদ ইত্যাদি যতটা পারেন ব্যবহার করেন এবং আমাদের সামনে তাঁর বলার বিষয়কে ছবির মতো করে ফুটিয়ে তোলেন। 

দক্ষ লেখক বর্ণনার সাহায্যে কেবল যে কোনো বস্তু বা দৃশ্যকে ফুটিয়ে তোলেন তা নয়, বিশেষ ঘটনা, ধারণা এমনকী ভাবাবেগকেও দৃষ্টিগ্রাহ্য করে ফুটিয়ে তুলতে পারেন। 


বর্ণনামূলক রচনারীতির কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। যেমন : 
১. বক্তব্য বিষয়কে ফুটিয়ে তোলার জন্যে যতটা সম্ভব ইন্দ্রিয়ানুভূতিকে কাজে লাগানো এবং বিমূর্ত শব্দের বদলে যত বেশি পারা যায় মূর্ত শব্দ ব্যবহার করা;

২. বর্ণনামুলক রচনায় কোনো বিষয়ের সমস্ত দিক অনুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করা সম্ভব হয় না। তাই সময়সীমা ও রচনার পরিসরের কথা মনে রেখে এক্ষেত্রে এমন কিছু বিশেষ দিক বেছে নিতে হয় যেগুলো ছাড়া মূল বিষয়বস্তুর চিত্র ফুটিয়ে তোলা যায় না। 

৩. কোনো বিষয় বর্ণনা করার সময়ে এক ধরনের পরম্পরা বা ক্রমিক ধারাবাহিকতার দিকে লক্ষ রাখতে হয়। ‘ক্যামেরার চোখ’ যেমন করে ওপর থেকে নিচে, ডান থেকে বামে, বড় থেকে ছোট ইত্যাদি পদ্ধতিতে আমাদের সামনে ছবি ফুটিয়ে তোলে লেখককেও তেমনি প্রথমে একটি উপযুক্ত অবস্থানিক দৃষ্টি সম্পাত করে তারপর পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনায় যেতে হয়। 

৪. বর্ণনায় যে দিকটি গুরুত্ব পায় এবং তাতে লেখকের যে অনুভূতির প্রকাশ ঘটে- এ দুইয়ের সহযোগে সমস্ত বর্ণনার ভেতর দিয়ে বিষয়বস্তুর কোনো-না-কোনো দিক প্রধান হয়ে ওঠে। 

এধরনের লেখার দক্ষতা অর্জন করতে হলে মনের চোখকেও তৈরি করে নিতে হয় ’ক্যামেরার চোখের’ মতো করে। যা কিছু দেখা যায় তাকেই ফুটিয়ে তুলতে হয় লেখায়। তার সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হয় নিজের অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা। 

প্রবন্ধে বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা 
বিশ্লেষণ হচ্ছে কোনো কিছু খাঁটিয়ে পরীক্ষা বা বিচার করা। মননশীল প্রবন্ধ রচনায় বিশ্লেষণের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কোনো বস্তু বা ধারণার বৈশিষ্ট্য নিরূপণে, সমগ্র থেকে অংশকে আলাদা করে দেখার জন্যে, এক বা একাধিক জিনিজের মধ্যে সাদৃশ্য চিহ্নিত করতে, কোনো কিছুর মূল বা উৎস নির্ণয়ে এবং কার্যকারণ সম্পর্কে নির্ধারণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে আমাদের বিশ্লেষণ রীতি অবলম্বন করতে হয়। 

প্রবন্ধে সংজ্ঞাধর্মী আলোচনা 
সংজ্ঞা হচ্ছে কোনো গুরুত্বপূর্ণ শব্দ বা ধারণাকে ব্যাখ্যা করার এমন একটা কৌশল যেন ঐ শব্দ বা ধারণার মমার্থ যতটা সম্ভব প্রকাশ করা সম্ভব হয়। 

যে সমস্ত শব্দ দিয়ে কোনো জটিল বিষয় বা প্রক্রিয়া ইত্যাদি বোঝানো হয়ে থাকে সেগুলো নানা ভাবে, নানা দিক থেকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা চলে। সংজ্ঞার সাহায্যে কেবল মূল দিকটাই প্রকাশ পায়, অনেক, কিছুই অপ্রকাশিত থাকে। যেমন ‘স্বাধীনতা’‘গণতন্ত্র’‘উন্নয়ন’‘মুক্তবাজার’‘সভ্যতা’‘নারীমুক্তি’ ইত্যাদি। এ ধরনের শব্দের বা ধারণার পেছনে বিষয়ের যে ব্যাপ্তি থাকে সীমিত পরিসরের বাইরেও নানা ভাবে প্রকাশ করার দরকার পড়ে এবং সংজ্ঞাধর্মী আলোচনা এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট সহায়ক হয়ে থাকে। 

সংজ্ঞাধর্মী আলোচনায় লেখক নানা ধরনের পন্থা অবলম্বন করতে পারেন। যেমন একটি পন্থা হচ্ছে ঐ বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়ে সংজ্ঞা দিয়ে দেখাতে পারেন আলোচ্য বিষয়টি কোন কোন দিক থেকে আলাদা ও বিশিষ্ট। 

সংজ্ঞাধর্মী আলোচনার আর একটি পন্থা হচ্ছে শব্দের ব্যুৎপত্তি বা ভাষায় এর উৎস ও বিবর্তনের ইতিহাস দেখানো। যেমন ‘প্রবন্ধ’ শব্দটি এসেছে ‘বন্ধ’ শব্দ থেকে : প্র+বন্ধ। এর অর্থ : প্রকৃষ্টরূপে বন্ধন। 

তৃতীয় পদ্ধতি হচ্ছে নেতিকরণ পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে সংজ্ঞা দিয়ে যা কিছু বোঝানো হয় না, সেুগুলোই একে একে উপস্থাপন করা হয়। 

এ ছাড়াও লেখক সংজ্ঞাধর্মী আলোচনায় প্রয়োজনে বর্ণনামূলক ও বিশ্লেষণমূলক রীতি ইত্যাদির সহায়তা নিতে পারেন। এমন কি বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো ঘটনা বর্ণনা করে বিষয়টি সম্পর্কে সহজবোধ্য ধারণা তৈরি করাও চলে। 

এক কথায় সংজ্ঞাধর্মী আলোচনার কোনো ছকবাঁধা নিয়ম নেই। বিষয়বস্তুর ওপরই তা বহুলাংশে নির্ভর করে। বিষয়বস্তু তুলনামূলকভাবে সহজবোধ্য বা মূর্ত হলে আলোচনা হবে একরকম, আর তা বিমূর্ত বা জটিল হলে আলোচনার ধারণ হবে অন্যরকম। 

প্রবন্ধে তুলনামূলক বিচার 
তুলনামূলক বিচার এমন এক পদ্ধতি যার মাধ্যমে দুই বা ততোধিক বিষয়ের মধ্যেকার সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়। তুলনামূলক বিচারের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে : 

১. সাধারণত দুটো দিক বিচার করা হয় : ক. সাদৃশ্য, খ. বৈপরীত্ব; 
২. যে দুটো বিষয়ের মধ্যে তুলনা করা হয় তাদের মধ্যে কোনো-না-কোনো সামাঞ্জস্যপূর্ণ সম্পর্ক থাকে; 
৩. উভয়ের মধ্যে তুলনা করার সময় লক্ষ রাখতে হয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলোর দিকে। 

তুলনামূলক পদ্ধতির আশ্রয় নিয়ে প্রবন্ধ রচনা করার সময় নিম্নলিখিত দিকগুলো বিবেচনায় থাকা দরকার: 

১. যে যে বিষয়ে এবং যে যে মানদণ্ডে তুলনা করতে চাও শুরুতেই তার উল্লেখ থাকা ভালো; 

২. তুলনার মূলত তিনটি পন্থা রয়েছে : 
     ক. প্রথম বিষয়ের সবগুলো দিক উল্লেখ করে তারপর দ্বিতীয় বিষয়ের সবগুলো দিক উল্লেখ করা; 
     খ. প্রথম ও দ্বিতীয় বিষয় পাশাপাশি রেখে একের পর এক বৈশিষ্ট্যের তুলনা করা; 
     গ. যুগপৎ উভয় পদ্ধতির ইচ্ছেমতো ব্যবহার। 

তুলনার সময় উভয় বিষয়কেই সম গুরুত্ব দিতে হয়। তোমার পুরো লেখায় তুলনীয় বিষয়ের একটিকে প্রাধান্য দিয়ে অন্য বিষয়টি দায়সারা ভাবে সেরে ফেলা উচিত নয়। 

এ ধরনের রচনায় উপযুক্ত বিন্যাস ও সামঞ্জস্যপূর্ণ ভারসাম্য রাখা খুবই দরকার। 

প্রবন্ধে কার্যকারণ বিশ্লেষণ 
অনেক রচনায় সংশ্লিষ্ট বিষয়, ঘটনা বা অবস্থার কারণ ও তার ফলাফল পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন পড়ে। একে বলা হয় কার্যকারণ বিশ্লেষণ। এই পন্থায় কোনো ব্যাপার কেন ঘটে কিংবা কোনো ঘটনা বা ব্যাপারের প্রতিক্রিয়া বা ফলাফল কী হয়- সে বিষয়ে আলোকপাত করতে হয়। পরিস্থিতির কারণ ও ফলাফলের মধ্যে যে সম্বন্ধ থাকে তা নিরূপণ বা বিশ্লেষণ করাও এ ধরনের রচনার অন্যতম লক্ষ। নিচের উদাহরণগুলোতে কার্যকারণ সম্পর্ক বিশ্লেষণ লক্ষ করা যেতে পারে :

কারণ
ফলাফল
চারপাশে আবর্জনা ছড়ালে
রোগ বিস্তার ঘটে।
কলকারখানার ধোঁয়া
বায়ু দূষিত করে।

কার্যকারণ সম্বন্ধ বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে কয়েকটি দিক বিশেষ লক্ষ রাখা দরকার :
১. যে পরিস্থিতি ঘটছে তার কারণ কী কী? সম্ভাব্য কারণগুলোর মধ্য থেকে প্রধান বা মূল কারণ নির্ধারণ।
২. প্রধান ও অপ্রধান কারণ চিহ্নিত করার পর প্রামাণিক তথ্য বা উদাহরণ দিয়ে সেগুলোর প্রতিষ্ঠা করা দরকার। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত, কিংবা বিশেষজ্ঞের মতামত কাজে লাগাতে হয়। তথ্য-প্রমাণ ও যুক্তি যত অকাট্য হয় লেখার গুরুত্ব ততই বাড়ে।
৩. কার্যকারণ বিশ্লেষণ কালে কারণ ও ফলাফলের মধ্যে আলোচনা কেন্দ্রীভূত রাখা চলে। বিশ্লেষণের সময়ে এ দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করলে ভালো হয়। তবে এ ক্ষেত্রে সবগুলো সূত্র বা দিক যথাসম্ভব বিবেচনায় রাখা দরকার। গুরুত্ব অনুসারে প্রদান ও অপ্রধান কারণ এবং সেগুলোর ফলাফল নির্দেশ করা দরকার। সবগুলো উপাদান বিবেচনায় না নিলে অতি সরলীকরণের মতো ব্যাপার ঘটতে পারে।

প্রবন্ধের কাঠামো
প্রবন্ধে সাধারণত তিনটি অংশ থাকে : ভূমিকা মূল অংশ ও উপসংহার। এ ধরনের ভাগ এমন হতে হবে যেন ভূমিকা ও অপসংহার মূল রচনার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো হয় ভূমিকাকে সূচনা হিসেবে মূল অংশকে মধ্যভাগ হিসেবে এবং উপসংহারকে রচনার শেষ ভাগ হিসেবে মনে করা।

ভূমিকা : ভূমিকা হচ্ছে প্রবন্ধের প্রারম্ভিক বা সূচনা অংশ। এ অংশ অনেকটা রচনার মূল বিষয়ের ঢোকার দরজার মতো। ভূমিকা হবে বিষয়-অনুগ, আকর্ষণীয় হৃদয়গ্রাহী। তাতে যেন অপ্রাসঙ্গিক ও অনাবশ্যক বক্তব্য ভিড় না করে, এবং তার অকারণ বিস্তৃতিও যেন না ঘটে।

মূল অংশ : প্রবন্ধের মূল বিষয় বা বক্তব্য এই অংশে সন্নিবেশিত হয়। এ অংশে যেসব প্রসঙ্গ আলোচিত হয় তা আলাদা আলাদা অনুচ্ছেদে বিন্যস্ত করতে হয়। প্রয়োজনে প্রতিটি অনুচ্ছেদের শুরুতে সংকেত (Point) নির্দেশ করা যেতে পারে। সংকেত-সূত্রের ক্রমপরম্পরা রক্ষা করা দরকার। পরম্পরার ধরণ অনেক ক্ষেত্রেই বিষয়বস্তুর ওপর নির্ভরশীল। যেমন স্মৃতিকথার মতো ঘটনা বর্ণনার সময় বা কালগত পরম্পরা রক্ষা করতে হয়।

ভ্রমণ বৃত্তান্তের মতো বিবরণধর্মী রচনায় ভৌগোলিক স্থানগত পরম্পরা রক্ষার প্রয়োজন পড়ে। কোনো সমস্যা নিয়ে প্রবন্ধ রচনা করতে গেলে সমস্যাগুলোকে শ্রেণিবদ্ধ করে একে একে সেগুলোর ওপর আলোকপাত করতে হয় এবং সেই সঙ্গে সমস্যার কারণ ও সমাধানের পথ নির্দেশ করারও প্রয়োজন পড়ে। চিন্তামূলক রচনার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট বিষয় থেকে সাধারণ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার রীতিতেও এক ধরনের পরম্পরা থাকে। তা হলো সুনির্দিষ্ট থেকে সাধারণে উত্তরণ। একে বিশেষ থেকে নির্বিশেষে উত্তরণও বলা যেতে পারে। এরই বিপরীত পন্থা হচ্ছে সাধারণ থেকে সুনির্দিষ্টে পৌঁছানো অর্থাৎ নির্বিশেষ থেকে বিশেষে উপনীত হওয়া। মূল অংশ যেভাবেই বিন্যস্ত করা হোক না কেন প্রবন্ধ রচনার আগে তার একটা ছক তৈরি করে নেওয়া ভালো।

উপসংহার : প্রবন্ধের ভাববস্তু বা বক্তব্য শুরু থেকে রচনার মধ্যাংশ পর্যন্ত যে ধারাবাহিকতা বা ক্রমপরম্পরা নিয়ে অগ্রসর হয় তা একটা ভাবব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে শেষ হয় উপসংহারে এসে। উপসংহারে তাই বক্তব্যের সমাপ্তিসূচক একটা ভাব প্রধান হয়ে উঠলে তাকে সার্থক মনে হয়। এ ছাড়াও উপসংহারে লেখক ব্যক্তিগত অভিমত প্রকাশ করতে পারেন। সংকট উত্তরণের দিক-নির্দেশনার সারাংসের ব্যক্ত করারও সুযোগ থাকে উপসংহারে। তাই ভূমিকা অংশের মতো উপসংহার অংশও রচনার সার্থকতার পক্ষে বিশেষ গুরুত্ববহ।

প্রবন্ধ রচনায় দক্ষতা অর্জনের উপায়
প্রবন্ধ রচনায় রাতারাতি দক্ষতা অর্জন করা যায় না। এ জন্যে নিয়মিত অনুশীলন ছাড়াও নিম্নলিখিত দিকগুলো সহায়ক ভূমিকা পালন করে :

১. প্রবন্ধ লেখায় দক্ষতা অর্জনের জন্যে প্রচুর প্রবন্ধ ও রচনা পড়তে হয় এবং কোন বিষয়ে কী বক্তব্য কীভাবে উপস্থাপিত হয়েছে তা খুঁটিয়ে দেখতে হয়। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধ, সংবাদ, প্রতিবেদন, ফিচার ইত্যাদি নিয়মিত পাঠ করলে নানা বিষয়ে বিষয়গত ধারণা ও শব্দ ভাণ্ডার বাড়ে। এতে প্রবন্ধ লেখা সহজ হয়ে ওঠে।

২. প্রবন্ধের বিষয় সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট হওয়া দরকার। প্রবন্ধের মর্মবস্তু যুক্তি, তথ্য, তত্ত্ব, বিচার-বিশ্লেষণ ইত্যাদি বিষয়ানুগ, প্রাসঙ্গিক ও সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। অপ্রাসঙ্গিক বাহুল্য ও অনাবশ্যক বিস্তৃতি উৎকৃষ্ট প্রবন্ধের পরিপন্থী। এ জন্যে প্রবন্ধ রচনায় পরিমিতিবোধের পরিচয় দিতে হয়। একই বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে সেদিকেও লক্ষ রাখতে হয়।

৩. প্রবন্ধের বক্তব্য বাস্তব তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে এবং যৌক্তিক পরম্পরায় উপস্থাপিত ও সন্নিবেশিত হওয়া উচিত যেন তা স্পষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার সহায়ক হয়।

৪. প্রবন্ধ রচনায় ভাষার ওপর সহজ দক্ষতা থাকা দরকার। প্রবন্ধের ভাষা হবে বিষয় ও ভাবের অনুগামী। চিন্তাশীল মননধর্মী প্রবন্ধের ভাষা হবে ভাবগম্ভীর। পক্ষান্তরে ব্যক্তিগত লঘু রচনায় ভাষা হবে হালকা লঘু চালের এবং তাতে প্রয়োজনমতো আবেগধর্মিতাকেও স্পর্শ করতে পারে।

৫. ভাষা-রীতির ক্ষেত্রে সাধু ও চলিত যেন মিশে না যায় সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিক বাংলায় যেহেতু চলিত রীতিরই জয়জয়কার সে জন্যে চলিত রীতি অবলম্বন করে প্রবন্ধ লেখার চর্চা করা ভালো।

৬. প্রবন্ধের ভাষা হবে প্রাঞ্জল ও শুদ্ধ। প্রবন্ধের উৎকর্ষ নির্ভর করে নির্ভুল বানানে ও নির্ভুল বাক্য-গঠনের ওপর। তাই প্রবন্ধ রচনার ক্ষেত্রে ভাষার অপপ্রয়োগ সম্পর্কে শিক্ষার্থীকে সবসময় সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে।

৭. প্রবন্ধ রচনায় অযথা ও অপাসঙ্গিক তথ্য-উপাত্ত উদ্ধৃতি ব্যবহার করা উচিত নয়। পরীক্ষক সব সময় দেখেন সন্নিবেশিত তথ্য বা উদ্ধৃতি প্রাসঙ্গিক কিনা।

৮. প্রবন্ধে প্রাসঙ্গিক তথ্য-উপাত্ত সন্নিবেশ ছাড়াও বক্তব্যকে জোরালো করার জন্যে প্রবাদ-প্রবচন, উদ্ধৃতি ইত্যাদি সন্নিবেশ করা চলে। তবে সুদীর্ঘ উদ্ধৃতি পরিহার করা উচিত। প্রবন্ধ যেন উদ্ধৃতিবহুল না হয়ে ওঠে সেদিকেও বিশেষ নজর রাখা দরকার।

৯. লেখকের অভিজ্ঞতা, শিক্ষা, চিন্তাশক্তি, দক্ষতা, পঠন-পাঠন, ভাষা-দক্ষতা, উপস্থাপনা-রীতি ইত্যাদির পার্থক্যের কারণে একজন ছাত্রের রচনার সঙ্গে অন্যজনের রচনা হুবহু মেলে না। এটিই বাস্তব। নিজের ভাষায় সুন্দরভাবে গুছিয়ে নির্ভুলভাবে লিখতে পেরেছ কিনা পরীক্ষক সেটাই দেখেন। এমন কোনো ছক বাঁধা নির্দিষ্ট রীতি নেই যা অনুসরণ করলে সবচেয়ে সার্থক রচনা লেখা যায়।
Labels:

Post a Comment

[facebook][blogger]

Author Name

Contact Form

Name

Email *

Message *

Powered by Blogger.