↬ বাংলাদেশের নিঃস্বর্গে ষড়ঋতুর প্রভাব
↬ বাংলাদেশের ঋতুচক্র
↬ বাংলাদেশের ঋতু বৈচিত্র্য
ভূমিকা : এক অসাধারণ সৌন্দর্যপটের নাম বাংলাদেশ। প্রকৃতির মায়া মমতা যার আপন বৈশিষ্ট্য। যে দেশকে বিধাতা সাজিয়েছেন তাঁর আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে, সুচারুরূপে, বর্ণাঢ্য করে। সে দেশর নাম বাংলাদেশ। যে দেশের সৌন্দর্যের মাঝে নেই কোন কৃত্রিমতার ছোঁয়া, আছে কেবল প্রগাঢ় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সমারোহ, সে দেশর নাম বাংলাদেশ। নিসর্গ যে দেশের অলংকার, প্রকৃতি যে দেশের রূপ সুষমার মূল উপকরণ, সে দেশেইতো বাংলাদেশ। অপূর্ব সৌন্দর্যে শস্য-সম্পদে আর প্রকৃতিক বৈচিত্র্যে ভরা এমন দেশ পৃথিবীতে আর একটিও নেই। এদেশে জন্মেছি আমি। আমি ধন্য। আমি তৃপ্ত। এ-বাংলার রূপে বিমুগ্ধ কবি আবেগে উদ্বেলিত হয়ে তাই গেয়ে ওঠেন-
↬ বাংলাদেশের ঋতুচক্র
↬ বাংলাদেশের ঋতু বৈচিত্র্য
ভূমিকা : এক অসাধারণ সৌন্দর্যপটের নাম বাংলাদেশ। প্রকৃতির মায়া মমতা যার আপন বৈশিষ্ট্য। যে দেশকে বিধাতা সাজিয়েছেন তাঁর আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে, সুচারুরূপে, বর্ণাঢ্য করে। সে দেশর নাম বাংলাদেশ। যে দেশের সৌন্দর্যের মাঝে নেই কোন কৃত্রিমতার ছোঁয়া, আছে কেবল প্রগাঢ় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সমারোহ, সে দেশর নাম বাংলাদেশ। নিসর্গ যে দেশের অলংকার, প্রকৃতি যে দেশের রূপ সুষমার মূল উপকরণ, সে দেশেইতো বাংলাদেশ। অপূর্ব সৌন্দর্যে শস্য-সম্পদে আর প্রকৃতিক বৈচিত্র্যে ভরা এমন দেশ পৃথিবীতে আর একটিও নেই। এদেশে জন্মেছি আমি। আমি ধন্য। আমি তৃপ্ত। এ-বাংলার রূপে বিমুগ্ধ কবি আবেগে উদ্বেলিত হয়ে তাই গেয়ে ওঠেন-
“ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা,
আমাদের এই বসুন্ধরা,
তাহার মাঝে আছে দেশ এক
সকল দেশের সেরা;
ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ,
স্মৃতি দিয়ে ঘেরা।”
আমাদের এই বসুন্ধরা,
তাহার মাঝে আছে দেশ এক
সকল দেশের সেরা;
ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ,
স্মৃতি দিয়ে ঘেরা।”
বাংলার সীমা ও ভূ-প্রকৃতি : ত্রিশ লক্ষ মানুষ যে দেশের জন্য জীবন দিতে পারে, সে দেশ কি যেই-সেই দেশ। সাড়ে সাত কোটি মানুষ দেশপ্রেমে উদ্বেলিত হয়ে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর অর্জন করে স্বধীন বাংলাদেশ। এ বাংলাকে ঘিরে উত্তর দিকে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের শ্যমলিমায় জলপাইগুড়ি ও কুচবিহার, উত্তর-পূর্বদিকে আসামের পর্বতময় অঞ্চল, পূর্বে বৈচিত্র্যময় দেশ বার্মা, পশ্চিমে পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের সমভূমি আর সর্বদক্ষিণে রয়েছে চির প্রবহমান বঙ্গোপসাগরের শীতল জলধারা।
বাংলার সৌন্দর্য :
“বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছিতই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে চাই না আর।”
গ্রাম বাংলার রূপে বিমুগ্ধ রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের এ স্বীকারোক্তিতেই প্রতীয়মান হয় বংলার গ্রামীণ সৌন্দর্য। গ্রামকে বাদ দিয়ে বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কোন চিহ্নসূত্রই থাকবে না। গ্রাম প্রধান দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। তই বাংলার যে দিকে দৃষ্টিপাত করি না কেন চোখে পড়ে শ্যামল শোভাশয় সবুজ অরণ্যানী। কোখাও বা মাঠের পর মাঠ আর সোনালি পাকা ধানের শোভা দৃশ্যমান। সেই ধানের ক্ষেতে যখন মৃদুমন্দ হাওয়া বয়ে যায়, তখন নাবযৌবনা কুমারীর মতই কলহাস্যে নেচে দুলে ওঠে সেই স্বর্ণ রূপিনী ধানের ক্ষেত। কোখাও আবার সারি সারি তাল-নারিকেল-খেজুরের বনানী, কোথাও বা সুজচ্চ বটবৃক্ষ মৌন তপস্যায় মাথা উঁচু করে ঊর্ধ্বপানে তার বাহু প্রসারিত করে আছে আর অকৃপণভাবে স্নেহশীতল ছায়া দান করছে দূরদূরান্ত থেকে আগাত পথিককে। কোখাও বা রাখাল ছেলে গরু-মেষগুলোকে চরাতে দিয়ে কোন সুশীতল তরু মূলে বসে বাঁশিতে তুলছে মেঠো সুর। বাংলার এসব দৃশ্য যুগে যুগে তার সন্তানদের করেছে বাউল, কবি, গল্পকার, চিত্রকার। বাংলার এ রূপ দৃষ্টেই কবিগুরু গেয়েছিলেন-
“অবারিত মাঠ গগন ললাট চুমে তব পদধূলি,
ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলি।”
ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলি।”
ঋতুবৈচিত্র্য ও বাংলার প্রকৃতি : বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আবর্তিত হয় এর ঋতুবৈচিত্র্যের সাথে সাথে। ছয়টি ঋতুর এক আশ্চর্য লীলা নিকেতন এই বাংলাদেশ। প্রতিটি ঋতুই বৈচিত্র্যে আর সৌন্দর্যে অনন্য।
গ্রীষ্মে : এখানে গ্রীষ্ম আসে সূর্যের প্রচন্ড দাবদাহ নিয়ে। গাছে গাছে পেকে ওঠে আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল প্রভৃতি ফল। মাঠ-ঘাঠ-প্রান্তর, জনজীবন সবকিছুই এ সময় মেতে ওঠে। প্রখর তাপদাহে জীবধাত্রী ধরিত্রীর বক্ষ বিধীর্ণ হয়ে যায়, চৌচির হয়ে যায় তার তৃষ্ণার্ত প্রান্তর। তাইতো কবি বলেছেন,
‘ঘাম ঝরে দর দর গ্রীষ্মের দুপুরে
মাঠ-ঘাট চৌচির, জল নেই পুকুরে।’
মাঠ-ঘাট চৌচির, জল নেই পুকুরে।’
বর্ষায় : গ্রীষ্ম বিদায় নেয় বর্ষার আগমনের সাথে সাথে। আষাঢ়ের জলধারা বাংলার প্রকৃতিকে দেয় চির সবুজ করে। খাল-বিল-নদী-নালা পানিতে থৈ থৈ করে তখন। কদম্ব, যুঁথী, কেয়া। কবি গেয়ে ওঠেন-
“নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে
তিল ঠাই আর নাহিরে
ওগো আজ তোরা যাসনে গোতোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।”
তিল ঠাই আর নাহিরে
ওগো আজ তোরা যাসনে গোতোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।”
শরতে : এর পর ধীরে ধীরে বর্ষার অবসান ঘটে এবং শরৎ তার শুভ্র জ্যোৎস্না ও পুষ্প সুষমা নিয়ে আগমন করে। বর্ষার নিপীড়িতা ধরণী আবার পুলকিত হয়ে ওঠে। শশীর উজ্জল কিরণে কি কাশবন, কি বনের বৃক্ষশীর্ষ, কি গৃহচূড়া, কি নদীর নির্জন বৃক্ষ সমস্তই হাস্যময়ীরূপ ধারণ করে। শরৎকালে শেফালী, কামিনী প্রভৃতি ফুল প্রস্ফুটিত হলে সৌন্দর্য সৌরভে সবাইকে মুগ্ধ করে। এ সময় কবি গেয়ে উঠেন-
“এবার অবগুণ্ঠন খোল
গহন মেঘ-মায়ায় বিজন বন ছায়ায়
তামার আঁচলে অবগুণ্ঠন সারা হল
শিউলি সরভি রাত বিকশিত জোচনাতে
মৃদু মর্মর গানে তব মর্মের বাণী বোলো।”
গহন মেঘ-মায়ায় বিজন বন ছায়ায়
তামার আঁচলে অবগুণ্ঠন সারা হল
শিউলি সরভি রাত বিকশিত জোচনাতে
মৃদু মর্মর গানে তব মর্মের বাণী বোলো।”
হেমন্তে : বাংলার মানুষের জীবনে নব আশার সঞ্চার করে প্রকৃতিতে এবার আগমন ঘটে পাকা ধানের গন্ধে মাতাল করা হেমন্তের। শস্যক্ষেত্র ধারণ করে এসময় হরিদ্রাবর্ণ, রাত্রিতে শিশির পড়ে ভিজিয়ে দেয় সতেজ ঘাসের ডগা। ভোরে সেই ভেজা ঘাসের ওপর ঝরে পড়ে শিউলি ফুল।
শীতে : গাছপালাকে শ্রীহীন করে, বিবর্ণ করে দিয়ে, এরপর প্রকৃতিতে ঝেঁকে বসে শীত বুড়ি। অবশ্য শীতে বাংলার প্রকৃতি পায় এক ব্যতিক্রমী সৌন্দর্য। চারদিকে সাদা কুয়াশার চাদর, ভোরে খেজুর রস পাড়ার দৃশ্য, নাড়ার আগুনে শিম পোড়ানো এ সবের মধ্যেই আছে এক স্বতন্ত্র আনন্দ।
ঋতুরাজ বসন্তে : সবশেষে প্রকৃতিরাজ্যে আগমন ঘটে ঋতুরাজ বসন্তের। গাছ-পালা নব পল¬বে সুশোভিত হয়ে ওঠে, ফুলে ফুলে মধুমক্ষিকার গুন গুন তান, গাছে গাছে কোকিলের গান মুখরিত হয়। রাতে জ্যোৎস্না ধারার মাঝে মন কেমন করে ওঠে। হৃদয় ফুঁড়ে বেরোয় গান-
“আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে,
বসন্তের এই মাতাল সমীকরণে।”
বসন্তের এই মাতাল সমীকরণে।”
উপসংহার : বাংলার প্রকৃতি এভাবেই তার বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্য বিকাশের মাধ্যমে আমাদের বিমোহিত করে আসছে। বাংলাদেশের প্রকৃতিতে যে সৌন্দর্য সম্ভার রয়েছে, তা তার একান্তই নিজস্ব সম্পদ। এমন সৌন্দর্য সম্ভার আর কোথাও খুঁজে পাওয়া দুর্লভ। বাংলার প্রকৃতি বিমুগ্ধ কবি তাই জীবনের চরম চাওয়া-পাওয়ার ঘটিয়েছেন এ প্রকৃতির বন্দনার মাধ্যমেই-
“কোন বনেতে জানিনে ফুল,
গন্ধে এমন করে আকুল।
কোন গগনে উঠেরে চাঁদ এমন হাঁসি হেসে,
আঁখি মেলে তোমার আলো
দেখে আমার চোখ জুড়ালো;
ঐ-আলোতেই নয়ন রেখে মুদবো নয়ন শেষে।”
[ একই রচনা আরেকটি বই থেকে সংগ্রহ করে দেয়া হলো: ]
ভূমিকা : কবি রবীন্দ্রনাথ ঋতু-বৈচিত্র্যে অভিভূত হয়ে লিখেছেন-
“ওমা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে,
মরি হায়, হায়রে-
ওমা, অঘ্রাণে তোর ভরা ক্ষেতে কী দেখেছি মধুর হাসি”
ঋতুরঙ্গমী রূপসী বাংলা। বঙ্গ-প্রকৃতির ঋতুরঙ্গে তার কী ছন্দময়, সংগীতময় অনুপম-রূপ বিস্তার। ঋতু পরিবর্তনের বর্ণ-বিচিত্র ধারাপথে নিয়ত উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তার অন্তহীন রূপের খেলা, রঙের খেলা, সুরের খেলা। অনুপম বৈচিত্র্যময় ঋতুরঙ্গের এমন উজ্জ্বল প্রকাশ বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোথাও দেখা যায় না। তাই রূপমুগ্ধ, বিষয়-পুলকিত কবি তাঁর আবেগ-স্নিগ্ধ উচ্চারণে বাংলাকে বলেছেন-‘রূপসী বাংলা’। ছয় ঋতুর দেশ এই রূপসী বাংলাদেশ। ছয় ঋতুর ছয় রূপ। প্রতিটি ঋতু এখানে আসে তার বৈচিত্র্য-বিলসিত স্বাতন্ত্র্যের অনুপম রূপসজ্জায়। রূপের ঐশ্বর্যে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে বাংলার পথ-প্রান্তর। এরপর বেজে ওঠে তার অশ্রুবিধুর বিদায়ের করুণ রাগিনী; সে তার রূপ বিস্তারে অন্তিম স্মৃতিচিহ্নটুকু নিঃশেষে মুছে নিয়ে চলে যায় কালের অনন্ত যাত্রাপথে। এক ঋতু যায়, আসে অন্য ঋতু।
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য : বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ, অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ। মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে এদেশে ঋতুর আবির্ভাব ঘটে এবং সেগুলো পর্যায়ক্রমে আবর্তিত হয়। ঋতুগুলোর তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত ও বায়ুপ্রবাহ একটি থেকে অপরটি পৃথক। সবুজ শ্যামল প্রকৃতির জন্যে এর প্রশংসা যুগ যুগ ধরে কবিদের বাণীতে উচ্চারিত হয়েছে। এর নদী-নালা, খাল-বিল, এর পাহাড়-টিলা, বন-বনানী, এর সমতল ভূমি মিলে- টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া- এক বিচিত্র রূপের অপূর্ব সমারোহ। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তার ঋতুবৈচিত্র্যের মধ্যে চমৎকারভাবে প্রত্যক্ষ করা যায়। বার মাসে ছয় ঋতুর এদেশে প্রতিটি ঋতু তার অনন্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে আগমন করে এবং নিজের অনাবিল সৌন্দর্য উপহার দিয়ে বিদায় নেয়।
বাংলাদেশের ঋতুভেদ : বাংলাদেশ ছয় ঋতুর দেশ। রূপসী বাংলার ছটি ঋতু যেন তার ছটি সন্তান। ছটি রঙের ছটি সুরের পাখি। দুই মাস মিলে এক একটি ঋতু : বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ গ্রীষ্মকাল; আষাঢ়-শ্রাবণ বর্ষাকাল; ভাদ্র-আশ্বিন শরৎকাল, কার্তিক-অগ্রহায়ণ হেমন্তকাল; পৌষ-মাঘ শীতকাল; ফাল্গুন-চৈত্র বসন্তকাল। স্বভাবেও এক একটি ঋতু এক এক রকম।
মৌনী-তাপস গ্রীষ্ম : বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ (এপ্রিল মাসের মধ্যভাগ থেকে জুন মাসের মধ্যভাগ পর্যন্ত) এই দুই মাস গ্রীষ্মকাল। বঙ্গ-প্রকৃতির ঋতুরঙ্গশালায় প্রথম ঋতু-নায়ক গ্রীষ্ম। বর্ষচক্রের প্রথম দৃশ্যেই ক্রুদ্ধ দু’চোখে প্রখর বহ্নিজ্বালা নিয়ে আবির্ভাব ঘটে এই মহাতাপসের। নির্দয় নিদাঘ-সূর্য কঠিন হাতে ছুঁড়ে মারে তার নিদারুণ খরতপ্ত অগ্নিবাণ। প্রখর তাপদাহে জীবধাত্রী ধরিত্রীর বক্ষ বিদীর্ণ হয়ে যায়, চৌচির হয়ে যায় তার তৃষ্ণার্ত প্রান্তর। তাই কবি বলেছেন,
‘ঘাম ঝরে দর দর গ্রীষ্মের দুপুরে
মাঠ-ঘাট চৌচির, জল নেই পুকুরে।’
গ্রীষ্মের মরু-রসনায় ধরিত্রীর প্রাণ-রস শোষিত হয়ে কম্পিত শিখা উঠতে থাকে মহাশূন্যে। এই দারুণ দহন-বেলা স্তব্ধ হয়ে যায় সকল পাখ-পাখালির। সর্বত্রই এক ধূসর মরুভূমির ধূ-ধূ বিস্তার। সমগ্র জীবজগতে নেমে আসে এক প্রাণহীন, রসহীন, পাণ্ডুর বিবর্ণতা। তারই মধ্যে একদিন কালবৈশাখীর আগমন ঘটে। গ্রীষ্ম ফুলের ঋতু নয়, ফুল ফোটবার তেমন কোনো তাড়া নেই তার; শুধু ফলের ডালা সাজিয়েই সে নিঃশব্দে বিদায় নেয়। এই ঋতুতে আম, জাম, জামরুল, কাঁঠাল, আনারস, পেয়ারা, লিচু, তরমুজ, আমড়া প্রভৃতি সুস্বাদু ফল জন্মে। গোলাপ, বকুল, বেলি, টগর, জবা প্রভৃতি সুগন্ধি ফুলও এ সময়ে ফোটে। এই ঋতুতে দিন বড় আর রাত ছোট হয়। গ্রীষ্ম দিয়েই শুরু হয় বাংলা বর্ষ। গ্রীষ্মের প্রথম দিনে পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন হিসেবে উদ্যাপিত হয়। বৈশাখের বড় আনন্দ এবং বড় উৎসবই হচ্ছে বৈশাখী মেলা। মেলায় চলে নানা রঙের খেলা। এ যেন আনন্দের মেলা।
সজল বর্ষা : বাংলা বর্ষের দ্বিতীয় ঋতু এবং এর স্থিতি আষাঢ় ও শ্রাবণ (জুন মাসের মাঝামাঝি থেকে আগস্ট মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত) এই দুই মাস। এই ঋতুতে আবহাওয়া সর্বদা উষ্ণ থাকে।
‘আমি বর্ষা, আসিলাম গ্রীষ্মের প্রদাহ শেষ করি
মায়ার কাজল চোখে, মমতায় বর্মপুট ভরি।’ -সুফিয়া কামাল।
গ্রীষ্ম পিপাসার্ত বাংলাদেশকে বর্ষার হাতে তৃষ্ণা নিবারণের ভার দিয়ে বিদায় নেয়। দূর-দিগন্তে ধূসর আকাশের বুকে স্তরে স্তরে জমে ওঠে নবীন মেঘের স্তূপ। এক অপূর্ব সমারোহে আকাশ-বাতাস ব্যাপ্ত করে আসে শ্যামল, সুন্দর, নয়নাভিরাম বর্ষা। মুহুর্মুহু বিদ্যুৎ ও গুরুগম্ভীর বজ্রনিনাদের ‘অতি-ভৈরব হরষে’র মধ্যে সূচিত হয় তার শুভাগমন। সেই সঙ্গে নিদাঘ-দগ্ধ পৃথিবীর ধূসর বুকে ঘনিয়ে আসে স্নিগ্ধ-শীতল ছায়াঘন দিন। আকাশে নিবিড়-কালো মেঘরাজির অপূর্ব স্তর-বিন্যাসে, নিচে বন-প্রকৃতির বুকে মেঘমেদুর ছায়া-বিস্তারে জেগে ওঠে পৃথিবীর বহু-প্রতীক্ষিত, মর্মর-মুখর মহোল্লাস। সুদূর দিগন্ত থেকে দূরন্ত বায়ু ছুটে আসে শোঁ-শোঁ শব্দে। শুরু হয় শীতল ধারা-বর্ষণ। বহুদিন পর বাংলার শুষ্ক প্রান্তরে, নদী-নালায় ও খাল-বিলে জাগে কল-মুখরিত প্রবল প্রাণোচ্ছ্বাস। বহুদিন পর বাংলার বুকে আবার শোনা যায় নানা সংগীতমুখর সুধাকণ্ঠ পাখির কল-কুজন। মাটির কঠিন শাসন ভেদ করে নবীন শস্য-শিশুর দল বেরিয়ে পড়ে নবজীবনের জয়যাত্রায়। কদম্ব, কেয়া, জুঁই, গন্ধরাজ, হাসনাহেনার বিচিত্র বর্ণ ও গন্ধের উৎসবে বঙ্গ-প্রকৃতির হৃদয়ের দ্বার যেন খুলে যায়। তাই কবি কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে,
‘গুরু গুরু ডাকে দেয়া, ফুটিছে কদম কেয়া-
ময়ুর পেখম তুলে সুখে তান ধরেছে
বর্ষার ঝরঝর সারাদিন ঝরছে।’
এ সময় গ্রামাঞ্চলে যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম হয়ে ওঠে নৌকা। বর্ষায় নদী-নালা, খাল-বিল ও পুকুর-ডোবা কানায় কানায় ভরে ওঠে। বিলে বিলে হেলেঞ্চা, কলমিলতা আর শাপলার সমারোহ দেখা যায়। বর্ষাকালে কেয়া, কদম, কামিনী, জুঁই, গন্ধরাজ প্রভৃতি সুগন্ধি ফুল ফোটে। এ ঋতুতে প্রচুর ইলিশ মাছ পাওয়া যায়। তারপর আকাশে আকাশে বেজে ওঠে বর্ষা বিদায়ের বিষণ্ণ মাদল। বার্ষিক মোট বৃষ্টিপাতের ৮০ ভাগেরও অধিক বর্ষাকালেই সংঘটিত হয়। অত্যধিক বৃষ্টিপাতের কারণে অধিকাংশ প্লাবনভূমিই বর্ষাকালে প্লাবিত হয়। ডুবে যায় ফসলের মাঠ, শহরের বস্তি। ভেঙে পড়ে কাঁচা ঘরবাড়ি। ঘরে ঘরে শুধু হয় জ্বরজারি আর পেটের পীড়া। এভাবে সুখে-দুঃখে-আনন্দে একসময় আষাঢ় শ্রাবণের দিন ফুরোয়। শুকনো মাটির বুকে রসের জোয়ার এনে বর্ষা বিদায় নেয়। ধুয়ে যায় যত সব আবর্জনা। বর্ষার অঢেল দানের মধ্যে কিছু কষ্টের স্মৃতিও রেখে যায় আমাদের মনের গভীরে।
শুভ্র শরৎ : বর্ষার অবসানে তৃতীয় ঋতু শরৎ এক অপূর্ব শোভা ধারণ করে আবির্ভূত হয়। ভাদ্র ও আশ্বিন (আগস্ট মাসের মধ্যভাগ থেকে অক্টোবর মাসের মধ্যভাগ পর্যন্ত) মিলে শরৎকাল। শরৎ ঋতুকে বলা হয় ঋতুর রানি।
‘আজি তোমার মধুর মুরতি হেরিনু শারদ প্রভাতে।’
বাংলার রূপের রঙ্গমঞ্চে এভাবেই শরতের আবির্ভাব। বর্ষণ-ক্ষান্ত লঘুভার মেঘ অলস-মন্থর ছন্দে নিরুদ্দেশে ভেসে চলে। বর্ষণ-ধৌত, মেঘমুক্ত আকাশের সুনীল রূপ-কান্তি, আলোছায়ার লুকোচুরি শিউলি ফুলের মন-উদাস করা গন্ধ, নদীতীরে কাশফুলের অপূর্ব শুভ্র সমারোহ, প্রভাতে তৃণ-পল্লবে নব-শিশিরের আলিম্পন, তাতে প্রভাত-সূর্যের রশ্মিপাত এবং শুভ জোছনা-পুলকিত রাত্রি- এই অনুপম রূপরাশি নিয়ে বাংলাদেশের পথে-প্রান্তরে রূপসী শরতের ঘটে আনন্দময় আবির্ভাব। তখন রূপালী জোছনার অপরূপ রথে চড়ে সৌন্দর্যের নানা উপচার ছড়াতে ছড়াতে যখন শরতের আগমন ঘটে, তখন চারদিকে রূপের দুয়ার যেন খুলে যায়। বাংলাদেশের অনির্বচনীয় রূপ-মাধুরী যেন পূর্ণ হয়ে ওঠে কানায় কানায়। কবি অভিভূত হয়ে গেয়ে ওঠেন-
“ধরার আঁচল ভরে দিলে প্রচুর সোনার ধানে,
দিগঙ্গনার অঙ্গন আজ পূর্ণ তোমার দানে।”
শরৎকালে বনে-উপবনে শিউলি, গোলাপ, বকুল, মল্লিকা, কামিনী, মাধবী প্রভৃতি ফুল ফোটে। বিলে-ঝিলে ফোটে শাপলা আর নদীর ধারে কাশফুল। এ সময়ে তাল গাছে তাল পাকে। হিন্দুদের দুর্গাপূজাও এ সময় অনুষ্ঠিত হয়।
ধূসর হেমন্ত : বাংলা বর্ষপঞ্জিতে এর ব্যাপ্তীকাল কার্তিক ও অগ্রহায়ণ (মধ্য অক্টোবর থেকে মধ্য ডিসেম্বর)। হেমন্ত শরতের বিলম্বিত রূপ। বঙ্গ-ঋতুনাট্যের সে চতুর্থ শিল্পী; উদাসীন, পৌঢ় এবং বিষণ্ণ। হেমন্তে নেই শরতের বনেশ্বর্য, আছে সুদূর-ব্যাপ্ত এক বৈরাগ্যের বিষণ্ণতা। রূপসী হেমন্ত ধূসর কুয়াশায় নয়ন ঢেকে ফসল ফলাবার নিঃসঙ্গ সাধনায় থাকে নিমগ্ন। ক্ষেতে-খামারে রাশি রাশি ভারা ভারা সোনার ধান উঠতে থাকে। চারদিকে অন্তহীন কর্মব্যস্ততা। ঘরে ঘরে চলছে নবান্ন উৎসব। প্রাচুর্যময়ী হেমন্তের ফুলের বাহার নেই, সৌন্দর্যের জৌলুস নেই, রূপ-সজ্জারও নেই প্রাচুর্য; আছে মমতাময়ী নারীর এক অনির্বচনীয় কল্যাণী রূপশ্রী। সে আমাদের ঘর সোনার ধানে ভরে দিয়ে শিশিরের মতো নিঃশব্দ চরণে বিদায় গ্রহণ করে।
রিক্ত শীত : ষড়ঋতুর পঞ্চম এবং উষ্ণতর গ্রীষ্মের বিপরীতে বছরের শীতলতম ঋতু। বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে পৌষ ও মাষ (মধ্য ডিসেম্বর থেকে মধ্য ফেব্রুয়ারি) এই দুই মাস শীতকাল। শীতকাল প্রধানত শুষ্ক। শীতের রাত্রী হয় দীর্ঘ। শীতের মহিমায় কবি আপ্লুত হয়ে গেয়ে ওঠেন-
“এল যে শীতের বেলা বরষ-পরে।
এবার ফসল কাটো, নাওগো ঘরে
করো ত্বরা, কাজ আছে মাঠ-ভরা-।”
শুষ্ক কঠিন প্রকৃতির পরিপূর্ণ রিক্ততা ও দিগন্তব্যাপী সুদূর বিষাদের প্রতিমূর্তি নিয়ে আসে হেমন্ত। বর্ণ-বৈভবহীন তার তাপ-বিরল রূপমূর্তির মধ্যে প্রচ্ছন্ন থাকে এক মহাজ্ঞানী তপস্বীর তপশ্চর্যা এবং অনন্ত বৈরাগ্যের ধূসর অঙ্গীকার। বিবর্ণ কানন-বীথির পাতায় পাতায় নিঃশেষে ঝরে যাবার নির্মম ডাক এসে পৌঁছায়। এক সীমাহীন রিক্ততার বেদনায় তার অসহায় ডালপালাগুলো একদিন হাহাকার করে কেঁদে ওঠে। তাকে সব দিতে হয়, দিয়ে যেতে হয়। এদিকে ধান কাটা মাঠে কি সীমাহীন শূন্যতা, কি বিশাল কারুণ্য।
শীতকাল বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর ও আরামদায়ক ঋতু। এ সময় তরিতরকারি প্রাচুর্য দেখা যায়। কপি, মূলা, বেগুন, পালংশাক মটরশুঁটি ইত্যাদিতে হাটবাজার পূর্ণ থাকে। কৈ, মাগুর, শিংহস অন্যান্য মাছ এ সময়ে প্রচুর পাওয়া যায়। এই ঋতুতে গাঁদা ও সূর্যমুখী ফুল ফোটে। কমলালেবু, বরই এ ঋতুরই ফল। শীতকালে খেজুর রস পাওয়া যায়। ঘরে ঘরে ভাপা, চিতই, পাটিসাপটা, পুলি ইত্যাদি পিঠা তৈরি করা হয়।
ঋতুরাজ বসন্ত : বাংলা বর্ষপঞ্জির সর্বশেষ ঋতু। ফাল্গুন ও চৈত্র মাস (ফেব্রুয়ারির মধ্যভাগ থেকে এপ্রিলের মধ্যভাগ পর্যন্ত) নিয়ে বসন্ত কাল হলেও শুধু মার্চ মাসেই ঋতুটির সংক্ষিপ্ত অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়।
“মাঘের সূর্য উত্তরায়ণে পাশ হয়ে” চলে আসে ঋতুশ্রেষ্ঠ বসন্ত, আসে পুষ্পারতির পরম লগ্ন। বঙ্গ-ঋতুনাট্যের অন্তিম রূপ-শিল্পী সে। মৃদু-মন্দ দখিনা বাতাসের জাদুস্পর্শে বর্ণ-বিরল পৃথিবীর সর্বাঙ্গে লাগে অপূর্ব পুলক-প্রবাহ, বন-বীথির রিক্ত শাখায় জাগে কচি কচি কিশলয়ের অফুরন্ত উল্লাস। বাতাসের মৃদু মর্মর-ধ্বনি এবং দূর বনান্তরাল থেকে ভেসে-আসা কোকিলের কুহুগীতি পৃথিবীতে সৃষ্টি করে এক অপরূপ মায়া-নিকেতন। আশোক-পলাশের রঙিন বিহ্বলতায় ও শিমুল-কৃষ্ণচূড়ায় বিপুল উল্লাসের, বিকশিত মধুমালতী ও মাধবী-মঞ্জরির গন্ধমদির উচ্ছল প্রগল্ভতায়-সারা গগনতলে বর্ণ, গন্ধ ও গানের তুমুল কোলাহলে লেগে যায় এক আশ্চর্য মাতামাতি-
‘মহুয়ার মালা গলে কে তুমি এল
নয়ন ভুলানো লুপে কে তুমি এলে।’
বসন্তকে বলা হয় ঋতুরাজ। এ সময়টি নাতিশীতোষ্ণ, তাই পরম সুখকর। এই ঋতুতেই হিন্দুদের বাসন্তী পূজা, দোলযাত্রা প্রভৃতি উৎসব মহাসমারোহে অনুষ্ঠিত হয়।
উপসংহার :
‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,
সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি।’
শুধু জননী জন্মভূমি রূপেই নয়, রূপসী বাংলার এই ষড়ঋতু নানা বর্ণ-গন্ধ গানের সমারোহে নিত্য-আবর্তিত হয়ে চলে। কিন্তু শহরবাসী ও শহরমুখী বাঙালি আজ আর অন্তরে অনুভব করে না তার সাদর নিয়ন্ত্রণ। ঋতু-পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে প্রকৃতি যখন বিবাহের কন্যার মতো অপরূপ সাজে সেজে উঠবে বাঙালি তখন শুনবে কলকারখানার যন্ত্র-ঘর্ঘর-ধ্বনি কিংবা কম্পিউটারে অঙ্ক মেলাতে ব্যস্ত থাকবে সওদাগরি অফিসে। এভাবেই পরিসমাপ্তি ঘটে ষড়ঋতুর রূপ বৈচিত্র্যের সমারোহ। বাংলাদেশের অর্থনীতি, পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা, ব্যবসা-বাণিজ্য, সাহিত্য-সংস্কৃতি তথা সামগ্রিক জীবনধারা ষড়ঋতুর দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত।
Post a Comment