ভূমিকা:
২। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ
৩। বাল্য বিবাহের অবসান
৪। নারী শিক্ষার প্রসার
৫। আইন প্রণয়ন ও আইনের প্রতি আস্থা
৬। জনসংখ্যার পুনর্বণ্টন
৭। জাতীয় আয় পুনর্বণ্টন
৮। আত্ম-কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা
৯। বেকারত্ব দূর করা
১০। জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি প্রয়োগ ও পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ
“বাঙ্গালার অতিশয় প্রজাবৃদ্ধিই বাঙ্গালার প্রজার অবনতির কারণ। প্রজাবাহুল্য হইতে অন্নাভাব,
অন্নাভাব হইতে অপুষ্টি, শীর্ণ শরীরত্ব, জ্বরাদি পীড়া এবং মানসিক দৌর্বল্য।”
-বঙ্কিমচন্দ্র।
সামগ্রিকভাবে আন্তর্জাতিক সমস্যা হিসেবে বর্তমান বিশ্বে অন্যতম প্রধান সমস্যা হচ্ছে জনসংখ্যা সমস্যা। এ সমস্যা গোটা পৃথিবীর জন্য শুধু ভয়াবহই নয়, সরাসরি হুমকি স্বরূপ। জনসংখ্যার এই অবিশ্বাস্য গতিবৃদ্ধিকে বর্তমানে জনসংখ্যা বিস্ফোরণ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এই জনসংখ্যা বিস্ফোরণ প্রতিটি দেশের উন্নতির প্রধান অন্তরায়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতই বাংলাদেশের প্রধান সমস্যাগুলোর মধ্যে জনসংখ্যা সমস্যা অন্যতম। এ প্রসঙ্গে মহাজ্ঞানী Aristotle এর উক্তিটি গ্রহণযোগ্য, “Optimum population is a boon, Over population is a bane.”
জনসংখ্যা সমস্যার স্বরূপ: Human Resource Development গন্থে বলা হয়েছে, “Man might do anything good for man if he lies in an optimum level.” অপর পক্ষে বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ টমাস রবার্ট ম্যালথাস জনসংখ্যার স্বরূপ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। তাঁর মতে, জনসংখ্যার আধিক্যই দেশের চরম অর্থনৈতিক দুর্গতি ও অবনতির মূল কারণ। তাঁর মতবাদ অনুযায়ী জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় গুণোত্তর প্রগতিতে আর জীবন ও জীবিকা সংস্থানের ক্ষেত্রে চরম অসামঞ্জস্যতা দেখা যায়। উন্নয়ন ও অগ্রগতি ব্যাহত হয়। বর্বোপরি জীবনযাত্রার মান নেমে আসে।
বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতি-প্রকৃতি, বর্তমান অবস্থা ও ভয়াবহতা: পৃথিবীর ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। আয়তনের দিক থেকে বিশ্বের ৩০০০ ভাগের এক ভাগ মাত্র বাংলাদেশ কিন্তু জনসংখ্যার দিক দিয়ে পৃতিবীর মধ্যে বাংলাদেশ অষ্টম স্থানে অবস্থান করছে। ১৯০১ সালে বাংলাদেশে লোকসংখ্যা ছিল প্রায় পৌনে তিন কোটি। আর তার একশ বছর পরে এই জনসংখ্যা বেড়ে ২০০১ সালে ১৩ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। এ হিসাব আর অবান্তর নয় যে ২০৫০ সালে এদেশের জনসংখ্যা দ্বিগুণ হবে। এভাবে জনসংখ্যা বাড়তে থাকলে অচিরেই দেশের অবস্থা যে কিরূপ ভয়াবহ হবে সে কথা কল্পনা করতেও ভয় হয়। নিচে ১৮০১-২০১১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার, বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ও ঘনত্ব দেখানো হল:
বছর
|
জনসংখ্যা (মিলিয়ন)
|
শতকরা হিসেবে বৃদ্ধি
|
বার্ষিক প্রবৃদ্ধি
|
ঘনত্ব (প্রতি কি. মি.)
|
১৮৮১
|
২৫.০৯
|
-
|
-
|
১৮০
|
১৯০১
|
২৮.৯২
|
-
|
-
|
২০৬
|
১৯২১
|
৩৩.২৫
|
-
|
-
|
২৪০
|
১৯৪১
|
৪১.৯৯
|
-
|
-
|
৩০০
|
১৯৫১
|
৪৪.১৬
|
৫.১৭
|
০.৫০
|
৩১৫
|
১৯৬১
|
৫৫.২২
|
২৫.১৬
|
২.২৬
|
৪২৫
|
১৯৭৪
|
৭৬.৩৯
|
২৮.৩৫
|
২.৪৮
|
৫৩৫
|
১৯৮১
|
৮৯.৯১
|
১৭.৬৯
|
২.৩২
|
৬২৫
|
১৯৯১
|
১১১.৪৬
|
২২.২০
|
২.০৩
|
৭২০
|
২০০১
|
১২৯.২৫
|
১৫.৯৬
|
১.৫৩
|
৮৩২
|
২০১১
|
১৫৮.৫৭
|
২২.৯৮
|
১.৫৬
|
১০৭৫
|
উৎস: সচিত্র বাংলাদেশ, ২০১১; চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর, ঢাকা।
বর্তমানে খাদ্যের অভাবে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী দিশেহারা। দেশের সর্বত্র আজ একটানা হাহাকার- অন্ন চাই, বস্ত্র চাই, মাথা গুঁজবার ঠাঁই চাই। দেশের সীমিত সম্পদের পরিপ্রেক্ষিতে এই বিশাল জনগোষ্ঠী আমাদের উন্নয়নের পথে বিরাট বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের জনসাধারণের মাথাপিছু আয় ও নিম্ন জীবনযাত্রার মান ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্যতা, বিপুল খাদ্য ঘাটতিসহ ব্যাপক বেকারত্ব, অপুষ্টি ও নিরক্ষরতা সহ গোটা জাতি দিন দিন অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণ: বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অত্যন্ত বেশি। এর করণ হিসেবে ভৌগোলিক পরিবেশ, অশিক্ষা, নিম্নমানের জীবনযাত্রা, ধর্মীয় ও সামাজিক প্রভাব, কুসংস্কার, খাদ্যাভ্যাস, বাল্যবিবাহ, জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে অজ্ঞতা, মৃত্যুর হার হ্রাস, বিনোদনের অভাব, দারিদ্র্য ও কর্মহীনতা, আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তার অভাব প্রভৃতিকে দায়ী করা যায়।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির অসুবিধা/কুফল: যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সে দেশের জনসংখ্যার গঠন ও বন্টনের উপর নির্ভরশীল। দেশের সম্পদের তুলনায় জনসংখ্যা অধিক হলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হয়। বাংলাদেশের অধিক জনসংখ্যা নিম্ন লিখিত সমস্যাগুলোর সৃষ্টি করে:
১। খাদ্য ঘাটতি ২। মাথাপিছু আয় হ্রাস পায় ৩। ভূমির খন্ড-বিখন্ডতা বৃদ্ধি পায় ৪। শিক্ষার অভাব দেখা দেয় ৫। সুবিধালাভে বঞ্চিত হতে হয় ৬। বাসস্থানের সমস্যা ৭। চলাফেরায় অসুবিধা হয় ৮। মূল্যবোধে চিড় ধরে | ৯। বিদেশি ঋণ বাড়ে ১০। মূলধন গঠনে বাধা আসে ১১। ভূমিহীন মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় ১২। চিকিৎসার অভাব দেখা দেয় ১৩। কাঁচামাল উৎপাদন ব্যাহত হয় ১৪। পরনির্ভরশীলতা বাড়ে ১৫। জীবনীশক্তি হ্রাস পায় ১৬। প্রতিযোগিতার রেষারেষি তীব্র হয় | ১৭। বেকারত্ব বৃদ্ধি পায় ১৮। কৃষি জমির পরিমাণ হ্রাস পায় ১৯। শিল্পোন্নয়নে বাধা আসে ২০। পুষ্টিহীনতায় ভোগে ২১। পরিবেশ দূষণ দেখা দেয় ২২। দুর্ভিক্ষ, মহামারী দেখা দেয় ২৩। সামাজিক অপরাধের মাত্রা বাড়ে ২৪। জাতীয় জীবনে নেমে আসে অস্থরতা |
সমস্যা সমাধানের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও গৃহীত পদক্ষেপ: দিনে দিনে জনসংখ্যা সমস্যা যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, তা সমাধানের কোনো নির্ভরযোগ্য উদ্যোগ গৃহীত হয় নি। গোটা বিশ্বই আজ জনসংখ্যা সমস্যার শিকার। তাই বিশ্ব মানবতার কল্যাণে জাতিসংঘের মাধ্যমে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারও জনসংখ্যা সমস্যার ভয়াবহতা উপলব্ধি করেছেন। জন্মহার রোধ, তে-খামার ও কল-কারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধিকল্পে সরকার দ্বিমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। এ প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও পরিবার পরিকল্পনা ‘স্বনির্ভর গ্রাম’ কর্মসূচির আওতাভুক্ত করা হয়েছে। একইসাথে জনসংখ্যা বৃদ্ধি কমানোর জন্যে নিম্নোক্ত ব্যবস্থাগুলো অবলম্বন করলে বাংলাদেশের জনসংখ্যা সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে:
১। অর্থনৈতিক উন্নয়ন২। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ
৩। বাল্য বিবাহের অবসান
৪। নারী শিক্ষার প্রসার
৫। আইন প্রণয়ন ও আইনের প্রতি আস্থা
৬। জনসংখ্যার পুনর্বণ্টন
৭। জাতীয় আয় পুনর্বণ্টন
৮। আত্ম-কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা
৯। বেকারত্ব দূর করা
১০। জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি প্রয়োগ ও পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ
জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি: বাংলাদেশের জনসংখ্যা দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং জাতীয় অর্থনীতিতে এটি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। জনসংখ্যাধিক্য এমন একটি সমস্যা যাকে শুধু প্রতিরোধ করা যায় কিন্তু একবার প্রকট আকার ধারণ করলে তা মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এমতাবস্থায় পরিবার পরিকল্পনাই একমাত্র মাধ্যম। বাংলাদেশের জনসংখ্যা সমস্যা সমাধান করার জন্য পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাই এই পদ্ধতিতে-
“ছেলে হোক মেয়ে হোক, দু’টি সন্তানই যথেষ্ট
দু’টি সন্তানের বেশি নয়, একটি হলে ভালো হয়।”
এই স্লোাগানই সরকার প্রচার করছে। কিন্তু ধর্মীয় গোঁড়ামী, শিক্ষার অভাব, জনগণের অজ্ঞতা, দারিদ্র্য, সরঞ্জামের অভাব প্রভৃতি কারণে এ কর্মসূচি তেমন সাফল্য লাভ করতে পারছে না।
উপসংহার: বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্রকে আত্মনির্ভরশীল উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে গড়তে হলে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ অবশ্যই করতে হবে। জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি খুব দ্রুত বাস্তবায়িত না হলে জনসংখ্যার বিস্ফোরণের অভিশাপ থেকে এই দেশ কখনোই মুক্ত হবে না। তাই এর আশু সমাধানে পারিবারিক, সামাজিক ও দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
Post a Comment